চীন যেভাবে হয়ে উঠলো উদ্ভাবনের পাওয়ারহাউজ
চীনের কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই ইলেকট্রিক গাড়ি এবং লিথিয়াম ব্যাটারির মতো খাতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এখন তারা মানুষের মতো দেখতে রোবট (হিউম্যানয়েড রোবট) তৈরির মতো নতুন ক্ষেত্রেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
চীন যেভাবে হয়ে উঠলো উদ্ভাবনের পাওয়ারহাউজ
চীনের কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই ইলেকট্রিক গাড়ি এবং লিথিয়াম ব্যাটারির মতো খাতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এখন তারা মানুষের মতো দেখতে রোবট (হিউম্যানয়েড রোবট) তৈরির মতো নতুন ক্ষেত্রেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
বেশিরভাগ স্টার্টআপ কোম্পানিরই বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে সময় লাগে, বিশেষ করে যখন বিষয়টি বিপজ্জনক প্রযুক্তি নিয়ে হয়। কিন্তু চীনের হেফেই শহরের কোম্পানি ফিউশন এনার্জি টেক-এর গল্পটা একেবারেই আলাদা।
মাত্র দুই বছর আগে একটি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র থেকে এই কোম্পানিটি তৈরি হয়েছে। জুলাই মাসে তারা ঘোষণা করে যে, তারা প্লাজমা প্রযুক্তিকে বাণিজ্যিক রূপ দেবে। এই প্রযুক্তি পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে একীভূত করে তৈরি হয়, যা সূর্যের চেয়েও বহুগুণ বেশি উত্তাপ সৃষ্টি করে। এরই মধ্যে তারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি নিরাপত্তা স্ক্রিনিং যন্ত্র তৈরি করেছে, যা এখন স্থানীয় মেট্রো স্টেশনগুলোতে দেখা যাচ্ছে এবং যাত্রীরা প্রতিদিন এর পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছেন।
চীনের সর্বোচ্চ নেতা শি জিনপিং নতুন প্রযুক্তিতে পশ্চিমকে হারানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চীনের কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই ইলেকট্রিক গাড়ি এবং লিথিয়াম ব্যাটারির মতো খাতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এখন তারা মানুষের মতো দেখতে রোবট (হিউম্যানয়েড রোবট) তৈরির মতো নতুন ক্ষেত্রেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
দেশের এই প্রযুক্তিগত সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারণ হলো দেশটির কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের নেয়া ব্যবস্থায় সরকারি গবেষণাগার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন আইডিয়াগুলোকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে প্রায়ই ‘ইনোভেশন চেইন’ বা ‘উদ্ভাবন শৃঙ্খল’ বলা হয়, যার ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি ঘটছে। তবে এই মডেলের খরচও বাড়ছে। সমালোচকদের মতে, এর ফলে দেশের সম্পদের বিশাল অপচয় হচ্ছে, যা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে টেনে নামাচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, এই ব্যবস্থা হয়তো বেশিদিন টিকবে না।
চীনের এই উদ্ভাবন শৃঙ্খল সাধারণত গবেষকদের অনুদান দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়, যারা রাষ্ট্রীয় গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ পান। এরপর সরকারি কর্মকর্তারা সেখান থেকে ভালো আইডিয়াগুলো খুঁজে বের করেন এবং গবেষণা দলগুলোকে কোম্পানি খুলতে সাহায্য করেন। এই প্রক্রিয়ার একটি দারুণ উদাহরণ হলো ‘থিসিউস’ নামের একটি কোম্পানি। ২০১৯ সালে এটি ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন বিজ্ঞানীর একটি দল, যারা তাদের গবেষণাকে কীভাবে ব্যবসায় রূপ দেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করতেন।
চংকিং-এর একটি জেলা সরকার তাদের প্রযুক্তিকে ঘিরে একটি সাপ্লাই চেইন তৈরির আশায় অর্থায়ন করে এবং ২০২০ সালে একটি শিল্পাঞ্চলে কোম্পানিটি চালু করতে সাহায্য করে। ২০২৪ সালের মধ্যে, থিসিউস তার ক্ষেত্রে একটি শীর্ষস্থানীয় নাম হয়ে ওঠে। তারা দেশের সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়োগ দিয়েছে এবং এই বছরের মে মাসে রাষ্ট্রীয় টেলিকম সংস্থা চায়না মোবাইলের সাথে মিলে অ্যামোলেড প্রযুক্তির একটি নতুন ডিসপ্লে স্ক্রিন তৈরি করেছে, যা গ্রাফিক্সকে আরও মসৃণ করে।
সরকারি গবেষণাগার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অন্যান্য উপায়েও তাদের উদ্ভাবন বিক্রি করছে। কিছু প্রতিষ্ঠান এমন অনলাইন মার্কেটপ্লেস তৈরি করেছে যেখানে কোম্পানিগুলো সরাসরি তাদের পেটেন্টের জন্য দর হাঁকতে পারে। যেমন, হারবিনের একটি কৃষিবিজ্ঞান অ্যাকাডেমি সম্প্রতি তাদের তৈরি একটি জেনেটিকালি মডিফায়েড সয়াবিনের পেটেন্ট নিলামে তুলেছিল। এ ধরনের ক্ষেত্রে, প্রযুক্তি কেনার পর কোম্পানিকে তা ব্যবহারে সাহায্যের জন্য প্রায়ই গবেষণাগার থেকে টেকনিশিয়ান পাঠানো হয়। চীনের বেসরকারি খাতের সাথে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর এই গভীর সম্পর্ক তাদের আয় দেখলেই বোঝা যায়। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে, ধারণা বিক্রি, যৌথ প্রযুক্তি উন্নয়ন বা পরামর্শ দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ২০৫ বিলিয়ন ইউয়ান (২৯ বিলিয়ন ডলার) হয়েছে।
এই সহযোগিতার সুবিধা দুপক্ষই পায়। জৈবপ্রযুক্তিতে সরকারি গবেষকরা তাদের কাজের জন্য বেসরকারি খাতের নানা সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারছেন। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রায়ই স্থানীয় কোম্পানিগুলোর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ পান, যা ব্যাকটেরিয়া উৎপাদনের জন্য জরুরি।
রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় চীনের বিজ্ঞান ও ব্যবসা জগতের মেলবন্ধনের সেরা উদাহরণ সম্ভবত হেফেই শহর। এই শহরের সরকার বেসরকারি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে, তাদের ঘিরে সাপ্লাই চেইন তৈরি করে এবং গবেষণাগার, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি খাতের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে কাজ করে। ফিউশন এনার্জি টেক তাদের অনেক সাফল্যের মধ্যে একটি। এই শহরে তৈরি প্লাজমা-ফিউশন ক্যান্সার চিকিৎসা এখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে এবং কোয়ান্টাম-সিকিওর মোবাইল পরিষেবা বাজারে চলে এসেছে। হেফেই-এর সরকার বিশেষ করে প্রযুক্তিগত বাধাগুলো দূর করার দিকে নজর দিয়েছে, যা একা বাজারের পক্ষে সমাধান করা কঠিন।
চীন সরকার এখন সারা দেশে এমন সফল সহযোগিতার মডেলগুলো ছড়িয়ে দিতে চাইছে। এপ্রিলে, লি লেচেং-কে শিল্প ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি দুটি অভ্যন্তরীণ শহরকে সবুজ শক্তির কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য পরিচিত। এটি ইঙ্গিত দেয় যে পার্টি ভবিষ্যতে এমন আরও রূপান্তর দেখতে চায়।
চীনের কোম্পানিগুলোর জন্য এই বিশাল উদ্ভাবনী পরিবেশ বেশ কিছু সুবিধা নিয়ে এসেছে। এর ফলে নতুন নতুন শিল্পে প্রবেশ করা সহজ হচ্ছে। যেমন, একসময়কার স্মার্টফোন নির্মাতা শাওমি মাত্র তিন বছরেই চীনে একটি সফল ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। এটি নতুন শিল্প তৈরিতেও সাহায্য করেছে। চীন এখন উড়ন্ত ট্যাক্সির মতো নতুন ব্যবসায় বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যার পেছনে রয়েছে তাদের ইলেকট্রিক গাড়ি এবং ড্রোন প্রযুক্তি উভয়েরই দক্ষতা।
উদ্ভাবন থেকে অচলাবস্থা
এত সাফল্য সত্ত্বেও, চীনের এই উদ্ভাবন মডেলের কিছু বড় অসুবিধা রয়েছে, যা দিন দিন বাড়ছে। দেশের জিডিপির প্রায় ২% বিভিন্ন শিল্পকে ভর্তুকি দিতে ব্যয় হয়। উদ্ভাবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা বাড়ার সাথে সাথে বেসরকারি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগ কমে গেছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে এই বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় ৪১% কমেছে।
রাষ্ট্রের এই বিপুল খরচের সুফলও এখন আর আগের মতো স্পষ্ট নয়। চীনের মোট উৎপাদনশীলতা, যা পুঁজি এবং শ্রমের দক্ষ ব্যবহার পরিমাপ করে, তা প্রায় থমকে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, যেমন নানিং শহরের ইলেকট্রিক গাড়ির সাপ্লাই চেইন তৈরির প্রচেষ্টা।
সরকারি ভর্তুকির কারণে অনেক শিল্পে মারাত্মক মাত্রায় অতিরিক্ত সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। যেমন, চীনের বেশিরভাগ ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মান ব্যাবসাই লাভজনক নয়। এখন বহু সংস্থা একই গ্রাহকের জন্য লড়াই করছে, যা এক তীব্র প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে যেখানে বিজয়ীর সংখ্যা খুব কম। এই অবস্থাকে প্রায়ই “ইনভোলিউশন” বলা হয়। এদিকে, বিদেশি সরকারগুলোর প্রতিরোধের কারণে বিদেশে বাজার খোঁজা কঠিন হয়ে পড়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, চীনে এমন কিছু প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে যার কোনো স্পষ্ট বাজার নেই। যেমন, হিউম্যানয়েড রোবট নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা অভিযোগ করেন যে বহু কোম্পানি প্রায় একই ধরনের পণ্য তৈরি করছে, কিন্তু সেগুলোর আসল চাহিদা খুব কম।
চীনের রাষ্ট্রীয় উদ্ভাবন নীতি অনেক বিশ্বমানের সংস্থা তৈরি করতে সাহায্য করেছে, কিন্তু বিনিয়োগের তুলনায় লাভের হার এতটাই কম যে এই মডেল হয়তো আর বেশিদিন চালানো সম্ভব হবে না। উদ্ভাবনে অর্থায়ন করতে গিয়ে চীনের ঋণের বোঝা বিশাল এবং অসহনীয় হয়ে উঠেছে। গত বছর, স্থানীয় সরকারের ঋণের হিসাবসহ মোট সরকারি ঋণ জিডিপির ১২৪ শতাংশে পৌঁছেছে। শেষ পর্যন্ত, শি জিনপিংয়ের কাছে হয়তো নতুন প্রযুক্তিতে সরকারি সহায়তা কমানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। আর তখন চীনের উদ্ভাবনের চেইন থমকে যেতে পারে।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা