9 DEC WEB
ছবি: আশিকুর রহমান সমী:

হাজারো রঙের বর্ণচ্ছটায় মোহময়ী সাজে সেজে ওঠা এই পৃথিবী যেন এক অনন্য ক্যানভাস, যেখানে প্রতিটি রং, প্রতিটি আলোছায়া নীরবে বুনে চলে সৌন্দর্যের এক চিরন্তন গল্প। আর এই অনুপম সৃষ্টির অন্যতম অলংকার হলো পাখি, নিসর্গের মতো স্বাধীন। তারা কখনো ভোরের আলো গায়ে মেখে, কখনো সন্ধ্যার আকাশে রঙের রেখা টেনে, মুক্তির প্রতীক হয়ে উড়ে বেড়ায় বিস্তৃত নীলিমায়। 

পাখিদের ডানার প্রতিটি ঝাপটায় লুকিয়ে থাকে জীবনের সুর, বাতাসের কবিতা, আর প্রকৃতির বুকে লেখা এক অমোঘ সংগীত, যার সুরে পৃথিবী আরও একটু নির্মল, আরও একটু সুন্দর হয়ে ওঠে। তবে এত সৌন্দর্যের পরও তারা অনন্য অবদান রাখে দেশের অর্থনীতিতে, যা আমাদের একেবারে অজানা। তাদের এই অবদান রয়ে গেছে উপেক্ষিত। 

বিশ্ব পরিবেশের ভারসম্য বজায় রাখাসহ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখছে পাখিরা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা আজ হুমকির মুখে। ক্রমাগত কমছে তাদের সংখ্যা, তারা সম্মুখীন হচ্ছে নানা প্রতিকূলতার। 

পাখিদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক, যা সরাসরি ও পরোক্ষভাবে কোটি কোটি ডলার মূল্যের সুবিধা মানবসমাজকে দিয়ে থাকে। প্রথমত, প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটন ও বার্ড-ওয়াচিং শিল্প বিশ্বব্যাপী একটি দ্রুত বর্ধনশীল খাত; শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বার্ড-ওয়াচিং-সংক্রান্ত ভ্রমণ, দুরবিন-ক্যামেরা কেনা, বাসস্থান, পরিবহন, গাইড সেবা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে বছরে ১০৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করে এবং ১৪ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে। এ খাতের মোট অর্থনৈতিক প্রভাব ২৭৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা পাখিকে একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক চালক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। 

দ্বিতীয়ত, বন্য পাখির বাস্তুতান্ত্রিক সেবা (ecosystem services) কৃষি ও বনায়নে সরাসরি আর্থিক সুবিধা প্রদান করে। বিশ্বব্যাপী পাখিরা বছরে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন টনের বেশি পোকামাকড় খেয়ে প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে কৃষকদের বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। 

গবেষণায় দেখা গেছে, পাখির উপস্থিতি ফসল উৎপাদন বাড়ায় এবং কৃষকদের প্রতি হেক্টর জমিতে ৭৫থেকে ৩১০ ডলার অতিরিক্ত আর্থিক লাভ এনে দেয়, যা কীটনাশকের খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। 

ছবি: আশিকুর রহমান সমী:

এছাড়া পরাগায়ন ও বীজ ছড়ানোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পাখিরা, যা বন পুনর্জন্ম, ভূমিক্ষয় রোধ এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অপরিহার্য। এসব সেবা মানুষের শ্রম বা প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে গেলে ব্যয় হতো লক্ষ লক্ষ থেকে কোটি ডলার পর্যন্ত। 

তৃতীয়ত, বন্য পাখি বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ, যার মাধ্যমে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের বার্ষিক মূল্য প্রায় ১২৫ থেকে ১৪০ ট্রিলিয়ন ডলার। এর উল্লেখযোগ্য অংশের সঙ্গে পাখির পরিবেশগত ভূমিকা গভীরভাবে জড়িত। 

পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাখিকেন্দ্রিক ইকো-ট্যুরিজম স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধির সুযোগ এবং টেকসই সম্পদ ব্যবহারের পথ তৈরি করে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প। 

সব মিলিয়ে, বন্য পাখি শুধু পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে না, বরং সরাসরি ও পরোক্ষ অর্থনৈতিক লাভ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, ব্যয় হ্রাস ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতিতে অমূল্য অবদান রাখে।

পাখি পরিবেশের অন্যতম জৈব-সূচক (bioindicator), কারণ কোনো অঞ্চলে পাখির প্রজাতির বৈচিত্র্য, সংখ্যাবৃদ্ধি বা হ্রাস সরাসরি সেই পরিবেশের গুণগত অবস্থা ও খাদ্যজালের স্থিতিশীলতাকে নির্দেশ করে। যেখানে পাখির উপস্থিতি ও প্রজাতি বৈচিত্র্য বেশি, সেখানে সাধারণত আবাসস্থল সুস্থ, জলাশয় উৎপাদনশীল, কীটনাশকের ব্যবহার কম এবং বাস্তুতন্ত্রের পুনরুৎপাদনের উচ্চ থাকে। বিপরীতে পাখির অনুপস্থিতি বা দ্রুত হ্রাস পরিবেশের অবক্ষয়, আবাসস্থল ধ্বংস, দূষণ, খাদ্যজালের ভাঙন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সংকেত দেয়। 

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭৩০ প্রজাতির পাখি নথিভুক্ত। এর মধ্যে ৩৫০টির বেশি পরিযায়ী, যারা এশিয়া-ইউরোপ-সাইবেরিয়া ফ্লাইওয়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খাদ্য, তাপমাত্রা, ঋতু পরিবর্তন ও প্রজনন চক্রের প্রয়োজনে মৌসুমি ভ্রমণ করে আসে। এই পরিযান শুধু শীতেই নয়, বরং বছরজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির স্বল্প ও দীর্ঘ দূরত্বের চলাচলের মাধ্যমেই ঘটে। বাংলাদেশের হাওড়-বাঁওড়, প্লাবনভূমি, অগভীর জলাশয়, বিল, চরের জলাভূমির জলচর পাখিরা ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে।

জলচর শিকারি পাখি (যেমন পানকৌড়ি, বক, মাছরাঙা) অসুস্থ বা দুর্বল মাছ ধরে ফেলে। বিজ্ঞান বলে, অসুস্থ মাছের রিমুভাল রেট যত বেশি হয়, জলাশয়ে রোগজীবাণুর সংক্রমণ তত কমে যায়, ফলে মাছের রোগ দ্রুত ছড়াতে পারে না। এটি প্রাকৃতিক রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

এছাড়া প্রতিদিন হাজারো জলচর পাখি মিলে প্রায় ১ টনের বেশি জৈব পদার্থ জলাশয়ে যুক্ত করে, যা নাইট্রোজেন-ফসফরাস-পটাশিয়ামসমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সারের মতো কাজ করে। এর ফলে পানির Microbial Productivity বাড়ে, প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদন বৃদ্ধি পায় (যা মাছের প্রধান খাদ্য), মাছের বৃদ্ধির হার ও উৎপাদন উভয়ই বাড়ে এবং জলাভূমির আশপাশের কৃষিজমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।

একইভাবে দেশের মাঠ ও ফসলি জমির পাখিরা প্রাকৃতিক শত্রু হিসেবে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পোকামাকড় খেয়ে ইন্টেগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে। আর শিকারি পাখি, বিশেষত প্যাঁচা, বাজ, চিল ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে অনন্য ভূমিকা রাখে। একটি প্যাঁচা তার জীবনকালে প্রায় ১০–১২ হাজার ইঁদুর খেয়ে কৃষকের প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকার সমমূল্যের ফসল রক্ষা করে বলে গবেষণায় প্রমাণিত। 

বনাঞ্চলের পাখিরা বীজ ছড়ানো, পরাগায়ন, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ এবং বন পুনর্জন্মে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তারা দেশের বনজ সম্পদকে রোগমুক্ত ও সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। মৃতভোজী পাখি, বিশেষত শকুন প্রাকৃতিকভাবে মৃত প্রাণী অপসারণ করে এনথ্রাক্স, র‍্যাবিসসহ বহু রোগজীবাণুর বিস্তার রোধ করে পরিবেশকে স্বাস্থ্যকর রাখতে বিশাল অবদান রাখে। 

ছবি: আশিকুর রহমান সমী:

এছাড়া শীতকালে বাংলাদেশের হাওড়-বাঁওড়, নদী, চরাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় হাজারো পাখির সমাগম স্থানীয় মানুষের জন্য পর্যটন, আলোকচিত্র, গাইডিং, আবাসন, নৌপরিবহন ও সরঞ্জামভিত্তিক ব্যবসার নতুন বাজার সৃষ্টি করে উল্লেখযোগ্য ইকো-অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি করে। যদিও জাতীয় পরিসংখ্যানে এই অর্থনৈতিক অবদান এখনো অন্তর্ভুক্ত নয়। 

কিন্তু এই বহুমুখী পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে পাখির অবস্থা ভালো নয়। দ্রুত হারে আবাসস্থল ধ্বংস, কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, জলাভূমি ভরাট, শিকার, বনায়নহানি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাখির সংখ্যা এবং প্রজাতি বৈচিত্র্য সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে। দেশে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ কার্যকর থাকলেও এতদিন মাঠ পর্যায়ে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাখি সংরক্ষণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে ছিল সচেতনতার ভাব। 

পাখিদের বাঁচাতে প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক গবেষণা বৃদ্ধি, আবাসস্থল পুনরুদ্ধার, জলাশয় রক্ষা। আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর নির্দেশনা অনুযায়ী কমপক্ষে ২০ শতাংশ এলাকা সংরক্ষিত ঘোষণার উদ্যোগ নিতে হবে। পরিকল্পিত সংরক্ষণ ছাড়া পাখি, বাস্তুতন্ত্র ও দেশের পরিবেশ-অর্থনীতি কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে না। 


  • আশিকুর রহমান সমী: বন্যপ্রাণী বিষয়ক গবেষক, পরিবেশবিদ ও লেখক; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব