রেইনফরেস্ট কি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান, নাকি উল্টো বিপদের কারণ?
আফ্রিকার বন এবং সাভানা অঞ্চলগুলো (তৃণভূমি) একসময় ‘কার্বন সিঙ্ক’ বা কার্বন আধার হিসেবে কাজ করত। অর্থাৎ এগুলো বাতাস থেকে কার্বন কমিয়ে তা গাছপালার মধ্যে জমিয়ে রাখত। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এখানে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে এগুলো কার্বন শোষকের ভূমিকা বদলে কার্বন নিঃসরণকারী উৎসে পরিণত হয়েছে।
রেইনফরেস্ট কি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান, নাকি উল্টো বিপদের কারণ?
আফ্রিকার বন এবং সাভানা অঞ্চলগুলো (তৃণভূমি) একসময় ‘কার্বন সিঙ্ক’ বা কার্বন আধার হিসেবে কাজ করত। অর্থাৎ এগুলো বাতাস থেকে কার্বন কমিয়ে তা গাছপালার মধ্যে জমিয়ে রাখত। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এখানে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে এগুলো কার্বন শোষকের ভূমিকা বদলে কার্বন নিঃসরণকারী উৎসে পরিণত হয়েছে।
মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে কিছু রেইনফরেস্ট এখন আর জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান দিচ্ছে না। উল্টো এগুলো এখন সমস্যার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন এক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল ‘নেচার’-এ এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আফ্রিকার বন এবং সাভানা অঞ্চলগুলো (তৃণভূমি) একসময় ‘কার্বন সিঙ্ক’ বা কার্বন আধার হিসেবে কাজ করত। অর্থাৎ এগুলো বাতাস থেকে কার্বন কমিয়ে তা গাছপালার মধ্যে জমিয়ে রাখত। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এখানে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে এগুলো কার্বন শোষকের ভূমিকা বদলে কার্বন নিঃসরণকারী উৎসে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের লেস্টার, শেফিল্ড এবং এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই তথ্য জানিয়েছেন। তারা ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্থ অবজারভেশনের হয়ে কাজ করেন। স্যাটেলাইট বা উপগ্রহের তথ্য ব্যবহার করে তারা গাছপালা ও বনাঞ্চল কী পরিমাণ কার্বন শুষে নিচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এই পরিবর্তনের প্রভাব খুবই গভীর। আফ্রিকার বনভূমি ঐতিহাসিকভাবে কার্বন শোষণের কাজ করেছে। কিন্তু এখন তারা বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণে এই ব্যবধান কমানো জরুরি ছিল।’
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি হলো ১৯৬টি দেশের মধ্যে হওয়া একটি সমঝোতা। এর উদ্দেশ্য জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা। বিশ্বের তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেশি বাড়তে না দেওয়া এই চুক্তির লক্ষ্য।
গবেষণায় কী পাওয়া গেছে?
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আফ্রিকার বনগুলো ‘বাড়তি চাপে’ আছে। তাই বাতাস থেকে কার্বন সরানোর ক্ষমতা তাদের কমে গেছে।
বর্তমানে আফ্রিকার বনগুলো বিশ্বের মোট কার্বন শোষণের পাঁচ ভাগের এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এই মহাদেশের সবচেয়ে বড় বন হলো কঙ্গো রেইনফরেস্ট। আমাজনের পরেই এর অবস্থান। একে প্রায়ই ‘আফ্রিকার ফুসফুস’ বলা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে আফ্রিকার বনগুলো প্রতি বছর ১০ কোটি ৬০ লাখ টন বায়োমাস বা জীবভর হারিয়েছে। বায়োমাস হলো গাছপালার মতো সজীব উপাদান। এর মানে হলো, বাতাস থেকে কার্বন শুষে নেওয়ার ক্ষমতা তাদের মারাত্মকভাবে কমে গেছে।
গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, মাদাগাস্কার এবং পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য অংশের ট্রপিক্যাল বা ক্রান্তীয় বনাঞ্চলগুলো এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এর কারণ কী?
শিল্প যুগে কার্বন নির্গমন জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। এর প্রধান কারণ কয়লা, তেল এবং গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো।
এতদিন বনগুলো এই অতিরিক্ত কার্বন শুষে নিতে বেশ দক্ষ ছিল। কিন্তু এখন কৃষিকাজ এবং উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রচুর গাছ কাটা হচ্ছে। ফলে বনের কার্বন শোষণের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। আফ্রিকায় জনসংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে এশিয়া থেকে রপ্তানি পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এতে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ পড়ছে। ফসল, কাঠ এবং জ্বালানির জন্য কৃষিজমি বাড়ানোর প্রয়োজন হচ্ছে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে থাকবে কি না, তা নির্ভর করবে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর। সম্পদ কতটা টেকসইভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।’
কার্বন সিঙ্ক কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?
‘সিঙ্ক’ হলো এমন কোনো এলাকা বা জলাশয়, যা নিজের উৎপাদনের চেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়।
ডাঙায় গাছপালা ও উদ্ভিদসমৃদ্ধ এলাকাগুলো কার্বন সিঙ্ক হিসেবে কাজ করে। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় এরা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। এরপর তা নিজেদের দেহে ও মাটিতে জমা রাখে। তবে কৃষিকাজ মাটির এই প্রক্রিয়ায় বাধা দিতে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন সিঙ্ক হলো সাগর। পরিবেশবাদী সংস্থা ‘ক্লায়েন্ট আর্থ’-এর মতে, সাগর পৃথিবীর মোট কার্বন নির্গমনের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ শুষে নেয়। পানির উপরিভাগে কার্বন ডাই-অক্সাইড মিশে যায় এবং সামুদ্রিক জীব সালোকসংশ্লেষণে তা গ্রহণ করে।
বিশ্বের আর কোন কোন এলাকা ঝুঁকিতে?
আমাজন রেইনফরেস্ট নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ‘আমাজন কনজারভেশন’ একটি তথ্য দিয়েছে। তারা বলছে, আমাজনে বন উজাড়ের কারণে কার্বন শোষণকারী গাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
পরিষ্কার করা জমিগুলো সাধারণত কৃষিকাজ ও গবাদিপশু পালনে ব্যবহার হয়। এগুলো থেকে আবার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়। এই গ্যাস তাপ আটকে রাখে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে।
তবে ব্রাজিল সরকার বন উজাড় রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই আমাজন আর কার্বন সিঙ্ক থাকবে না—এমন ভয় আপাতত দূর হয়েছে।
পরিবেশবাদী সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট’ (ডব্লিউআরআই) সতর্ক করেছে। তারা বলছে, বিশ্বের বনাঞ্চলগুলো যদি কার্বন শুষে নেওয়ার ক্ষমতা হারায়, তবে তা ‘মানুষ ও গ্রহের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি’ ডেকে আনবে।
সমাধান কী?
প্রতিবেদনের লেখকরা ব্রাজিলের একটি উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেছেন। এর নাম ‘ট্রপিক্যাল ফরেস্ট ফরেভার ফ্যাসিলিটি’ (টিএফএফএফ)। তাদের লক্ষ্য ১০ হাজার কোটি ডলার তহবিল সংগ্রহ করা। যারা নিজেদের বন অক্ষত রাখবে, সেই দেশগুলোকে এই অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি দাতা দেশ ৬৫০ কোটি ডলার দিয়েছে।
তাই প্রতিবেদনে আফ্রিকার কার্বন সিঙ্ক রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আরও জোর দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অন্যথায় প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্বন সিঙ্ক হারাবে বিশ্ব।’
এতে আরও বলা হয়, ‘আফ্রিকায় বায়োমাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্তরে পদক্ষেপ নিতে হবে। সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং বন ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হবে।’
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শেষ পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর বিকল্প নেই।
প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল জিওগ্রাফির অধ্যাপক হাইকো বালজটার ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ ম্যাগাজিনকে বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার অন্যতম হাতিয়ার হলো ক্রান্তীয় বনাঞ্চল। আমরা যদি এগুলো হারাতে থাকি, তবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর গতি আরও বাড়াতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো কমিয়ে আমাদের দ্রুত শূন্য নির্গমনের দিকে যেতে হবে।’