পরীক্ষায় ফেল চ্যাটজিপিটি: যেভাবে এই চ্যাটবট অপ্রাপ্তবয়স্কদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে

স্যাম অল্টম্যানের নেতৃত্বাধীন কোম্পানিটি স্বীকার করেছে, প্রতি সপ্তাহে ১০ লাখেরও বেশি ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটির সঙ্গে আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করে। তবে এর মধ্যে কতজন শিশু তা তারা জানায়নি। স্পেনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেখানে কিশোরীদের আত্মহত্যার হার গত চার দশকের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ।

uu224xmf3vdxzffw6yp7cdnkay
শিশুদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে এমন তথ্যও সরবরাহ করতে পারে চ্যাটজিপিটি।ছবি: সিন্তা আরিবাস

‘আমি আমার জীবন শেষ করে দিতে যাচ্ছি।’ চ্যাটজিপিটিকে বলা মারিও’র শেষ কথা ছিল এটাই। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ১৫ বছর বয়সী এই কাল্পনিক চরিত্রটি অ্যাপটির ‘প্যারেন্টাল কন্ট্রোল’ বা অভিভাবক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। তার মায়ের কাছে একটি ইমেইল সতর্কতা গেলেও ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়ে যায়। মারিও চ্যাটজিপিটির কাছে তার খাদ্যাভ্যাসজনিত সমস্যার কথা বললেও এআই তাকে এসব লুকানোর পরামর্শ দেয়। এমনকি তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তথ্যও দেয়। মারিও স্পষ্টভাবে আত্মহত্যার কথা জানালেও চ্যাটজিপিটির মালিক প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই তার বাবা-মাকে কোনো সতর্কবার্তা পাঠায়নি।

মারিও কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ নয়। চ্যাটজিপিটির শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষার জন্য খোলা তিনটি কাল্পনিক কিশোর-কিশোরীর অ্যাকাউন্ট এর মধ্যে মারিও একজন। বাকি দুজন হলো ১৩ বছর বয়সী লরা এবং ১৫ বছর বয়সী বিয়াট্রিজ। লরা শুরুতেই আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। আর বিয়াট্রিজ মাদক ও বিপজ্জনক যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল।

পাঁচজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এই কথোপকথনগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। তারা সবাই একমত যে, কিশোর-কিশোরীদের সুরক্ষায় ওপেনএআই-এর ব্যবস্থাগুলো যথেষ্ট নয়। চ্যাটজিপিটি যে তথ্য দেয় তা তাদের বিপদে ফেলতে পারে। সাইকোরজেন্সিয়াস-এর পরিচালক ও মনোবিজ্ঞানী পেদ্রো মার্টিন-বারাজন মোরান বলেন, ‘এটি বাবা-মাকে সময়মতো সতর্ক করে না, বা একেবারেই করে না। উল্টো এটি বিষাক্ত দ্রব্য ব্যবহার, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ এবং কীভাবে আত্মহত্যা করতে হয় সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়।’

যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ বছর বয়সী অ্যাডাম রেইন চ্যাটবটের কাছে আত্মহত্যার কথা বলার পর মারা যায়। এরপর গত সেপ্টেম্বরে ওপেনএআই কিশোরদের জন্য প্যারেন্টাল কন্ট্রোল চালু করে। তবে ক্যালিফোর্নিয়ায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আরও সাতটি মামলা চলছে। সেখানে অভিযোগ করা হয়েছে যে, চ্যাটজিপিটি ক্ষতিকর চিন্তাভাবনাকে উসকে দিচ্ছে এবং ‘আত্মহত্যার কোচ’ হিসেবে কাজ করছে। স্যাম অল্টম্যানের নেতৃত্বাধীন কোম্পানিটি স্বীকার করেছে, প্রতি সপ্তাহে ১০ লাখেরও বেশি ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটির সঙ্গে আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করে। তবে এর মধ্যে কতজন শিশু তা তারা জানায়নি। স্পেনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেখানে কিশোরীদের আত্মহত্যার হার গত চার দশকের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ।

শিশুদের জন্য বিপদ
চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের নিয়ম অনুযায়ী বয়স অন্তত ১৩ হতে হবে এবং ১৮ বছরের নিচে হলে অভিভাবকের সম্মতি লাগবে। কিন্তু এটি নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। পরীক্ষায় দেখা গেছে, চ্যাটজিপিটি মাদক ব্যবহার, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণ এবং বেআইনি কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে প্রতিবেদনটিতে সেসব ভয়ানক উদাহরণের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি।

মনোবিজ্ঞানী মারিবলে গমেজ বলেন, চ্যাটজিপিটি প্রায়ই কিশোরদের ক্ষতিকর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। স্প্যানিশ সোসাইটি অফ ইমার্জেন্সি মেডিসিনের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সমন্বয়ক রিকার্ডো দেলগাডো সানচেজ বলেন, ‘আমি অবাক হয়েছি যে এটি আত্মহত্যার স্থান ও পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছে।’ অথচ ওপেনএআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যান গত সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন, তারা চ্যাটজিপিটিকে এমনভাবে তৈরি করবেন যাতে এটি শিশুদের সঙ্গে আত্মহত্যা বা নিজের ক্ষতি করা নিয়ে কথা না বলে।

সূত্র: ইন্টারনেট ম্যাটার্স, ‘মি, মাইসেলফ অ্যান্ড এআই’ (যুক্তরাজ্য) / এল পাইস

আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এআই চ্যাটবট ব্যবহার করছে। অথচ এগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। যুক্তরাজ্যের একটি সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, ঝুঁকিতে থাকা শিশুরা বন্ধু হিসেবে বা একাকীত্ব কাটাতে এসব চ্যাটবট ব্যবহার করছে। চারজনের মধ্যে একজন শিশুর কাছে আসল মানুষের চেয়ে এআই চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলাটাই বেশি পছন্দের।

সতর্কবার্তা সবসময় কাজ করে না
সন্তান নিজের ক্ষতি করার চিন্তা করলে বাবা-মায়ের কাছে ইমেইল বা এসএমএস-এর মাধ্যমে সতর্কবার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা আছে চ্যাটজিপিটিতে। কিন্তু পরীক্ষায় দেখা গেছে, তিনটি ঘটনার মধ্যে মাত্র একটিতে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। বাকি দুটিতে শিশুটি বিপজ্জনক তথ্য খুঁজলেও কোনো বার্তা পাঠানো হয়নি।

বিয়াট্রিজ যখন বিপজ্জনক যৌন আচরণের কথা জানিয়ে বিদায় নিচ্ছিল, তখন চ্যাটজিপিটি তাকে বারণ করলেও বাবা-মাকে কোনো সতর্কবার্তা পাঠায়নি। মনোবিজ্ঞানী গমেজ মনে করেন, ‘এটি শিশুদের সুরক্ষার চেয়ে বাবা-মায়ের ভয় কাটানোর একটি বিপণন কৌশল মাত্র।’

বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করে বলছেন, শিশুরা চাইলে যেকোনো সময় এই প্যারেন্টাল কন্ট্রোল বন্ধ করে দিতে পারে। তাছাড়া এই ব্যবস্থা চালু করতে হলে শিশুর সম্মতির প্রয়োজন হয়, যা তারা প্রত্যাখ্যানও করতে পারে।

ধীর গতির প্রতিক্রিয়া
লরা আত্মহত্যার কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পর তার কাল্পনিক মায়ের কাছে ইমেইল সতর্কতা আসে। ওপেনএআই জানিয়েছে, ‘ভুল সতর্কতা’ এড়াতে মানুষের মাধ্যমে যাচাই করা হয় বলে দেরি হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার ঝুঁকির ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা দেরি মানে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাওয়া। মনোবিজ্ঞানী কারমেন গ্রাউ দেল ভালে বলেন, সময়মতো হস্তক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি আত্মহত্যার নোট লেখা পর্যন্ত গড়াতে পারে।

তথ্য গোপন করা
ইমেইলে কথোপকথনের বিস্তারিত থাকে না, শুধু কিছু সাধারণ পরামর্শ থাকে। মা যখন বিস্তারিত জানতে চান, তখন গোপনীয়তার কারণ দেখিয়ে ওপেনএআই তা জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। মনোবিজ্ঞানী মার্টিন-বারাজন বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকির প্রশ্নে শিশুর গোপনীয়তার চেয়ে তার জীবন বাঁচানোই বেশি জরুরি।’

বিচারক ইনোস সোরিয়া ব্যাখ্যা করেন, চ্যাটজিপিটি কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, তাই এর বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিচার করা যায় না। তবে তিনি মনে করেন, জীবন ও মৃত্যুর ঝুঁকির ক্ষেত্রে বাবা-মাকে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া উচিত।

মানসিক নির্ভরতা
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অরোরা আলেস পোর্টিলো বলেন, চ্যাটজিপিটি মানুষের মতো আবেগ দেখিয়ে কথা বলে, যেমন—’আমি তোমাকে বিচার করব না’ বা ‘আমি তোমাকে বুঝতে পারছি’। এটি শিশুদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক নির্ভরতা তৈরি করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চ্যাটবট কখনো দ্বিমত করে না বলে শিশুরা এর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি তিনজন কিশোরের একজন তাদের আসল বন্ধুদের চেয়ে এআই-এর সঙ্গে কথা বলে বেশি তৃপ্তি পায়।

বিশেষজ্ঞরা চ্যাটজিপিটি নিষিদ্ধ করার চেয়ে বয়সের সীমা বাড়িয়ে ১৪ বা ১৬ বছর করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া শিশুদের বন্ধ ঘরের বদলে বসার ঘরের মতো জায়গায় সবার সামনে এআই ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন। অরোরা আলেস বলেন, ‘শিশুদের ডিজিটাল সুরক্ষার দায় শুধু পরিবারের ওপর চাপালে হবে না, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও দায়িত্ব নিতে হবে।’