ইন্দোনেশিয়ার নতুন রাজধানী 'নুসানতারা': এই মহানগরীর ভবিষ্যৎ কী?
ইন্দোনেশিয়ার নতুন রাজধানী 'নুসানতারা': এই মহানগরীর ভবিষ্যৎ কী?
বোর্নিও দ্বীপের এক গহীন অঞ্চল। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন সোমবার। সদ্য পিচ ঢালা চকচকে ছয় লেনের রাস্তা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সেই বিশাল রাস্তায় কোনো গাড়িঘোড়া নেই, নেই শহরের চেনা কোলাহল। শুনশান রাস্তার মাঝখান দিয়ে একাই দৌড়াচ্ছেন এক ব্যক্তি। পাশেই পাহাড়ের চূড়ায় হাজার হাজার তামা দিয়ে তৈরি এক বিশাল পাখি ডানা মেলে আছে—ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় প্রতীক ‘গরুড়’।
এই হলো নুসানতারা। জঙ্গল কেটে শূন্য থেকে গড়ে তোলা ইন্দোনেশিয়ার স্বপ্নের নতুন রাজধানী।

নুসানতারায় সরকারি ভবনসংলগ্ন একটি পাঁচ লেনের সড়ক।
শহরটি গড়ার কাজ শুরুর তিন বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার এই ভবিষ্যৎ রাজধানীর ভবিষ্যৎ এখন খানিকটা কুয়াশাচ্ছন্ন। সরকারি কর্মকর্তাদের যে হারে এখানে আসার কথা ছিল, এসেছেন তার সামান্যই। পানির জোগান নিয়ে রয়েছে সংশয়। শপিং মল বা সিনেমা হলে যেতে হলে বাসিন্দাদের এখনো পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ পথ। অনেক ইন্দোনেশীয় তো এখন একে ‘ভুতুড়ে শহর’ বা ‘গোস্ট সিটি’ বলেই ডাকছেন।
তবুও থেমে নেই পর্যটকদের আনাগোনা। দেশটির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিয়মিত মানুষ আসছেন নুসানতারায়। বেশির ভাগ পর্যটক পূর্ব কালিমান্তান প্রদেশের প্রতিবেশী শহরগুলো থেকে গাড়ি চালিয়ে আসেন। কেউ কেউ বিমানে বালিকপাপান বিমানবন্দরে নেমে দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে দেখতে আসেন আগামীর এই শহরকে।
১০ মিনিটের শহর ও জীবনযাত্রার নতুন রূপ
নুসানতারার মূল দর্শন হলো এটি হবে ‘১০ মিনিটের শহর’। অর্থাৎ হাঁটা, সাইকেল বা গণপরিবহনে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে শহরের যেকোনো গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। বাসিন্দাদের চলাচলের জন্য রয়েছে ইলেকট্রিক শাটল বাস। এখানে কেবল পরিবেশবান্ধব গাড়ি চালানোর অনুমতি রয়েছে। জাকার্তার মতো বর্তমান রাজধানীর যানজটের নরকে বেড়ে ওঠা ইন্দোনেশীয়দের কাছে এটি এক বৈপ্লবিক ধারণা।

নুসান্তারাকে ‘১০ মিনিটের শহর’ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে—অর্থাৎ হাঁটা, সাইকেল চালানো বা গণপরিবহন ব্যবহার করে ১০ মিনিটের মধ্যেই যেন যে কেউ নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন।
শহরের নতুন বাসিন্দাদের অনেকেই ইন্দোনেশিয়ার অন্য প্রান্ত থেকে আসা তরুণ। তারা নিজেদের নতুন এক শহুরে জীবনের অগ্রদূত মনে করেন। যেমন ২৬ বছর বয়সী ডেটা কনসালট্যান্ট সিয়ামদোনি নাউইক। গত মার্চে তিনি এখানে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস গড়ার অংশ হতে পারাটা দারুণ ব্যাপার, তাই না?’
নুসানতারার একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের হোটেল ‘সুইসোটেল’-এর ফুড অ্যান্ড বেভারেজ বিভাগের সহকারী পরিচালক আদজি প্রমোনো (৪৮)। জাকার্তায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা আদজি সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি আর পুরোনো শহরে ফিরবেন না। জাকার্তায় সকাল ৮টায় কাজে পৌঁছাতে তাকে ভোর ৪টায় উঠতে হতো। তিনি বলেন, ‘ওখানে মনে হতো প্রতিদিন যাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তারা সবাই রেগে আছে।’ কিন্তু নুসানতারার পরিবেশটা সম্পূর্ণ ভিন্ন, শান্ত ও স্নিগ্ধ।
ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো রাজধানী স্থানান্তরের এই মহাযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। বর্তমান রাজধানী জাকার্তা ধীরে ধীরে জাভা সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে ৮০০ মাইল দূরে এই নতুন রাজধানী। পুরোনো জাভানিজ ভাষায় নুসানতারা মানে ‘দ্বীপপুঞ্জ’।

মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে সরকারি কর্মচারীরা।
তবে সমালোচকদের মতে, প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলারের এই প্রকল্প সাবেক প্রেসিডেন্ট জোকোর অহংকারের প্রতীক। গত বছর দায়িত্ব নেওয়ার পর তার উত্তরসূরি প্রাবোও সুবিয়ান্তো এখনো নুসানতারা সফরে যাননি। এমনকি তিনি উন্নয়ন বাজেটও কমিয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি শহরের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি মন্তব্য করেছেন, এটি একটি ‘রাজনৈতিক রাজধানী’ হিসেবেই থাকবে।

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নির্মিত অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। অনেক বাসিন্দার মতে, এখানে তাদের জীবনমান আরও উন্নত।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের পরিবেশ বেশ থমথমে। সুইসোটেল হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার ক্রেস্টিয়ান পেসিক জানান, সম্প্রতি নয়জন বিদেশি রাষ্ট্রদূত এই হোটেলে ছিলেন। তারা এখানে দূতাবাস খোলার সম্ভাবনা যাচাই করতে এসেছিলেন। ৪০ বছর বয়সী ক্রেস্টিয়ান বলেন, ‘যারা এই শহরের গল্প জানে না, তারা চোখ বন্ধ করে বলবে—এটা একটা ভুতুড়ে শহর হতে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে এলে বোঝা যায় শহরটি বড় হচ্ছে।’

কর্মস্থলে যেতে পরিবেশ বান্ধব শাটল বাস ব্যবহার করছেন সরকারি কর্মচারীরা।
শহরে বিনোদনের মাধ্যম কী—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দৌড়াই!’
আসলেই তাই। যেদিন প্রতিবেদক সেখানে পৌঁছান, সেদিন আয়োজকরা ৫০ কিলোমিটার বা ৩১ মাইলের একটি ট্রেইল রেস শেষ করছিলেন। নুসানতারা এখন পূর্ব কালিমান্তান প্রদেশের দৌড় প্রতিযোগিতার মূল ভেন্যু হয়ে উঠেছে।
পরিবেশের ক্ষতি নাকি উন্নয়ন
কর্মকর্তাদের দাবি, বর্তমানে শহরে লোকসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার। তবে গরুড় স্মৃতিস্তম্ভ ও নতুন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের আশপাশে মাত্র ১০ হাজার মানুষ বাস করেন, যাদের বেশির ভাগই নির্মাণশ্রমিক। নুসানতারা প্রায় ১ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা লস অ্যাঞ্জেলেসের প্রায় দ্বিগুণ। আপাতত এলাকাটিতে গাছপালাই বেশি। চারদিকে বিশাল ফাঁকা জায়গা। রেস্তোরাঁ ও মুদিদোকানের সংখ্যা হাতে গোনা। সবুজে ঘেরা হলেও এখানে ছায়া খুব কম। ফলে দুপুরের রোদ অসহনীয় হয়ে ওঠে।

নুসান্তারার একটি বনে বসবাস করছেন ডেটা পরামর্শক সিয়ামদোনি নাউইক।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, উন্নয়নের এই যজ্ঞে হাজার হাজার একর ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করা হয়েছে, যা বিপন্ন প্রোবোসিস বানরের আবাসস্থল। বালিকপাপান কোস্টাল ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রধান মাপ্পাসেল জানান, বালিকপাপানের সঙ্গে সংযোগকারী টোল রোড নির্মাণের ফলে পানির উৎস নষ্ট হয়েছে এবং সেখানে বন্যা বেড়েছে।
শহরের জন্য একটি বড় সমস্যা হতে পারে পানি। নুসানতারা ক্যাপিটাল সিটি কর্তৃপক্ষের সাবেক প্রধান বামবাং সুসান্তোনো জানান, সেপাকু নদীতে বাঁধ দেওয়ায় ২০৩০ সাল পর্যন্ত শহরটি নিরাপদ। এরপর কর্মকর্তাদের অন্য নদী থেকে পানি আনতে হবে। তিনি বলেন, ‘শহর গড়া মানে কেবল দালানকোঠা নয়, একটি সমাজ গড়ে তোলা। তা না হলে এটি আত্মাহীন শহরে পরিণত হবে।’

রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে বিশ্রাম নিচ্ছেন মানুষজন। আগামী ২০ বছরে শহরটির লক্ষ্যমাত্রা জনসংখ্যা ১৯ লাখে সীমিত রাখার পরিকল্পনা করছেন কর্মকর্তারা।
তবুও থেমে নেই ক্রেনের চাকা। শহরজুড়ে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। ২৩ বছরের তরুণী পুপুত রিয়ান্টির মতো অনেকেই এখানে স্বপ্ন বুনছেন। ৩০ মাইল দূরের শহর পেনাজম থেকে আসা এই তরুণী হবু বরের সঙ্গে বিয়ের আগের ছবি তুলতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা উন্নয়নটা অনুভব করতে চাই।’
জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সাবেক মন্ত্রী আন্দ্রিনফ চানিয়াগো মনে করেন, এখন আর পিছু হটার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘এখন আর ফিরে যাওয়া অসম্ভব। প্রকল্পটি বাতিল করা হলে যা কিছু তৈরি হয়েছে, সব জলে যাবে।’