হীরকজয়ন্তীতে কিং খানের উপাখ্যান
হীরকজয়ন্তীতে কিং খানের উপাখ্যান
নক্ষত্র—সীমাহীন আকাশে ধরাছোঁয়ার বাইরেই তার অবস্থান। তবে কখনো কখনো এই ধূলার ধরায় মাঝে মাঝে নেমে আসে সে, মানুষের রূপ ধরে, হৃদয়ের বেতাজ বাদশাহ হয়ে।
‘বাদশাহ’— এই শব্দটি শুনলে শাহরুখ খান ছাড়া আর কারো নাম মাথায় আসে কি? আমার আসেনি, আসবে না কখনোই। ১৯৯৫ সালের দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গের ‘রাজ’ কিংবা হালের ‘জাওয়ান’ চলচ্চিত্রের ‘আজাদ’ — নিজেকে পর্দায় যতবার সামনে এনেছেন, ততবারই দর্শকসারিতে থাকা আবালবৃদ্ধবনিতা তাকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন ‘কিং অব রোমান্স’ হিসেবে। ১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ দিয়ে বলিউডে পা রাখেন। তবে এর আগে ‘দুসরা কেভাল’ নামে একটি টিভি সিরিজেও কাজ করেছেন তিনি। ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে হিন্দি সিনেমার জগতে নক্ষত্রদের নক্ষত্র হয়ে আছেন যিনি, তিনি সেই আবদুল রশিদ খান, যাকে এই পুরো দুনিয়া চেনে শাহরুখ খান নামে।
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর —কিন্তু শাহরুখের বেলায় এই কথাটুকু ভুলে যেতে ইচ্ছা করে। নেটিজেনদের নানারকম পোস্টে, রীলসে এটাই প্রমাণিত হয় যে রোমান্স, থ্রিলার, হররের পাশাপাশি এসআরকে কে আয়েশে ধূমপান করতে দেখাও ভক্তদের কাছে একটা জনপ্রিয় জনরা!
ভক্ত, বিশেষ করে নারী ভক্তদের প্রশ্নে, তাদের উচ্ছ্বাসে, তাদের আবেদনে মাঝে মাঝেই লজ্জা পেয়ে হাতে চোখ ঢেকে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন, তাতে বলে উঠতে হয় — ঈয়ে লাড়কা হ্যায় আল্লাহ! হায় হায় রে আল্লাহ!
রুপালি পর্দায় যখন তার সিগনেচার পোজে — শরীর একটুখানি হেলিয়ে দুই হাত দুদিকে বাড়িয়ে — ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটিয়ে তোলেন, লাখো কিশোরী-তরুণী যেন নিজেকেই সেই আলিঙ্গনে নিজেকে কল্পনা করে। রোমান্সে ভরপুর দৃষ্টি দিয়ে নায়িকার প্রতি প্রেম নিবেদনের যে দৃশ্যগুলোতে তিনি উপস্থিত হন, তাতে প্রেমে না পড়ে উপায় থাকে না।
তার মোহনীয় চাহনি, সূক্ষ্ম রসবোধ আর আবেগে ভরপুর সংলাপগুলো তাকে পর্দায় বরাবরই করে তুলেছে আকর্ষণীয়। অভিনয় তো তার বাঁ হাতের খেলা। চমৎকার বাচনভঙ্গিতে, ভরাট কণ্ঠের শুদ্ধ আবৃত্তিতে তেরি আঁখো কি নামকিন মাস্তিয়া…নাহি ভুলুঙ্গা ম্যায়, জাব তাক হ্যায় জান, জাব তাক হ্যায় জান শুনে হৃদয় প্রকম্পিত হওয়াটাই বরং স্বাভাবিক।
তবে নায়ক শাহরুখ খানকে ছাপিয়ে ব্যক্তি শাহরুখ খানও চমৎকার একজন মানুষ। প্রচুর বই পড়েন, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেন। সহশিল্পী ও পুরো ইন্ডাস্ট্রির প্রতিটি মানুষের প্রতি তিনি প্রকাশ করেন অকৃত্রিম বিনয়।
এতদিন ধরে ফিল্মফেয়ার, আইফা সহ নানা ক্যাটাগরির নামী দামী সব পুরস্কার দিয়ে নিজের শোকেস সাজালেও, এ বছর তার ঝুলিতে যোগ হয়েছে ‘জাতীয় পুরস্কার’। একজন শাহরুখ ফ্যান হিসাবে এটা আমাকে আনন্দে ভাসায়। তবে স্বদেশ, মাই নেম ইজ খান এসব সিনেমার জন্য জাতীয় পুরস্কার না পেয়ে কেন ‘জাওয়ান’ সিনেমার জন্য পেলেন সেই কুতর্কে না গিয়ে আমি ফেসবুকে ঢুকে এসআরকে এর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আরো একটা পোস্ট শেয়ার করে আসব।
অনেক বলিউড অভিনেতা -অভিনেত্রী পাপারাজ্জিদের থেকে নজর এড়াতে চান, তারা চান সাধারণ মানুষের মত মুম্বাইয়ের জুহু বীচে আইসক্রিম খাবেন, নিজেদের মত নীরবে নিভৃতে একান্তে সময় কাটাবেন। অন্যদিকে অভিনেতা শাহরুখ খান তখনই হৃদয়ে রাজত্ব করেন যখন তিনি অকপটে বলে চলেন যে, এই তারকাখ্যাতি, এই আকাশচুম্বী আকর্ষণ, তাঁকে ঘিরে লাখো মানুষের উন্মাদনা-এসবে কখনো ক্লান্তি আসেনি তাঁর। বলিউড বাদশাহর সরল স্বীকারোক্তি- “ইয়ে সাব মুঝে চাহিয়েই নেহি। মে স্টার বানি হু, মুঝে আম আদমি কি তারহা নেহি রেহনা হ্যা। মুঝে স্টারওয়ালা জিন্দেগি হি চাহিয়ে”!
কিং খানের “আই অ্যাম লাস্ট অফ দ্যা স্টারস”-এই বাক্যটি প্রমাণ করে তাঁর কাজের প্রতি তাঁর অধ্যবসায়ই তাঁকে এই অতলান্তিক আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছে।
এতসব ভরপুর ফ্যানগার্লিং-ফ্যানবয়িং এর মাঝেও শাহরুখ ট্রলের শিকার হন, সেগুলো মজা করে সামলে নেন ক্ষুরধার রসব্যঞ্জনা দিয়ে। একবার লিপিকা নামের এক সাংবাদিক তাকে বারবার সালমান খান বলে ডাকার পর ‘স্যরি, শাহরুখ’ বলেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনিও সেই সাংবাদিককে ‘স্যরি দীপিকা’ বলে সম্বোধন করেন!
শাহরুখ খান জীবনের ছোট ছোট হাসি, আনন্দ, কষ্ট, বিষাদকে লার্জার দ্যান লাইফ আকারে স্ক্রিনে তুলে এনেছেন। আমরা খানসাহেবকে দেখি তিনি হাসছেন, কাঁদছেন, রোমান্স করছেন, গানে গলা মেলাচ্ছেন- এ তো আর দশটা নায়কই করে থাকেন। তবে তাঁর এই তুমুল জনপ্রিয়তার রহস্য কী?
আমরা যারা শাহরুখের ফ্যান, তারা একমত হতে পারি এটা তার ব্যক্তিত্ব। হ্যাঁ, এই ব্যক্তিত্বই এসআরকে কে অন্য অভিনেতাদের থেকে পৃথক করে, তাঁকে করে তোলে অনন্য, অসাধারণ, আরো ভালোবাসার, আরো কাছে চাওয়ার।
তবে শুধু অভিনেতা হিসেবেই নয়; বাবা, প্রেমিক, স্বামী, সহশিল্পী—জীবনের প্রতিটা চরিত্রে শাহরুখ খান একেবারে খাপে খাপ মিলিয়ে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে দেন। প্রচুর ব্যস্ততা আর কাজের ভীড়েও পরিবারকে ঠিক ঠিক সময় দেন। এই রাজকীয় পথচলায় স্ত্রী গৌরীর প্রশংসা আর তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এসবের জন্যই ‘শাহরুখ খান’- এই নামের অস্তিত্ব এই উপমহাদেশের মানুষের কাছে অবিস্মরণীয়।
দিল্লী থেকে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে সিনেমার শহর মুম্বাইয়ে বুকে পা রাখলেন, এরপর কেবল ইতিহাস রচিত হল। বান্দ্রার ‘মান্নাত’ – সে তো রাজপ্রাসাদের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। ভালোবাসা, অর্থ -সম্পদ, হুল্লোড়, আবেগের বাড়াবাড়ি, জনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস- এক জীবনে বলিউড বাদশাহর ঝুলি পূর্ণ হয়ে উঠেছে বহু আগেই। ২০২৫ এ পালন করবেন তাঁর হীরকজয়ন্তী, সামনে আসছে বহুল প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘কিং’। কিংয়ের ‘কিং’ এর জন্য শুভকামনা।
এত কথার ভীড়ে একটা কথাই বলা হল না, “আগার কিসি চীজ কো দিল সে চাহো, তো পুরি কায়িনাত উসসে তুমসে মিলানে কি কোশিশ মে লাগ যাতি হ্যায়”।
সত্যিই তো তাই!