20 OCT WEB
ছবি: ম্যাকিন্যাক আইল্যান্ড ট্যুরিজম বুর‍্যো

এখানে কোনো মোটরচালিত যান চলে না। এটিই আমেরিকার একমাত্র ‘মহাসড়ক’, যেখানে আপনি গাড়ি চালানোর অনুমতি পাবেন না। এমনকি গল্ফ কার্টও এখানকার রাস্তায় নিষিদ্ধ।

আমেরিকার মিশিগানকে আমরা চিনি ‘কার ক্যাপিটাল অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে। ফোর্ড, জেনারেল মোটরস, ক্রাইসলারের মতো বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম এই ডেট্রয়েট শহরেই। কিন্তু মিশিগানের উত্তরাঞ্চলে লেক হিউরনের শান্ত জলে ভেসে আছে ম্যাকিন্যাক নামের এক মনোরম দ্বীপ। এই দ্বীপ শত শত বছর ধরে পর্যটকদের কাছে এক অপার আকর্ষণ। আর মজার বিষয় হলো, গাড়ি আবিষ্কারের পর থেকেই এখানে সব ধরনের যান্ত্রিক যান নিষিদ্ধ!

৩ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ছোট্ট দ্বীপে সারা বছর ৬০০ জন মানুষ বসবাস করেন। এখানে কোনো মোটরচালিত যান চলে না। এটিই আমেরিকার একমাত্র ‘মহাসড়ক’, যেখানে আপনি গাড়ি চালানোর অনুমতি পাবেন না। এমনকি গল্ফ কার্টও এখানকার রাস্তায় নিষিদ্ধ। তাই যদি কখনো কোনো হর্ন বা চাকার কর্কশ শব্দ শোনেন, তবে নিশ্চিত থাকুন, তা দ্বীপের কোনো রাজহাঁস বা পেঁচার ডাক হবে!

কিন্তু কেন এখানে গাড়ি নিষিদ্ধ? দ্বীপের একটি হস্তশিল্পের দোকানের মালিক উরভানা ট্রেসি মোর্স বলেন, ‘এখানে ঘোড়াই রাজা!’ স্থানীয়দের মুখে ফেরা এক গল্প অনুসারে, ১৮৯৮ সালে একটি গাড়ি ব্যাকফায়ার করায় পাশ দিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ভয় পেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাম কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিন নিষিদ্ধ করে দেয়। দু’বছর পর এই নিষেধাজ্ঞা গোটা দ্বীপে প্রসারিত হয়। সেই থেকে স্থানীয়রা এই শান্ত, অতীতের সরল জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এখানকার সব কাজ সচল রেখেছে ঘোড়া। গ্রীষ্মকালে প্রায় ৬০০ ঘোড়া দ্বীপে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখ মানুষ মিশিগানের আপার পেনিনসুলার ম্যাকিনাও সিটি বা সেন্ট ইগনেস থেকে ২০ মিনিটের ফেরিতে করে ম্যাকিন্যাক দ্বীপে আসেন। 

মোর্স বলেন, ‘ময়লা সরানো থেকে শুরু করে ফেডেক্স ডেলিভারি পর্যন্ত সব কিছুতেই ঘোড়া ব্যবহার করা হয়। এটাই আমাদের জীবনযাত্রা, এটাই আমাদের গতি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একটি অংশ বাইকে করে বা হেঁটে কিংবা ঘোড়ার ট্যাক্সিতে যাতায়াতের এই ঐতিহ্যকে পছন্দ করে।’

ছবি: ম্যাকিন্যাক আইল্যান্ড ট্যুরিজম ব্যুরো

শত শত বছর ধরে আদিবাসী সম্প্রদায় লেক হিউরন এবং লেক মিশিগানের মাঝে থাকা এই দ্বীপটিকে মাছ ধরা ও শিকারের স্থান হিসেবে ব্যবহার করত। তারা এর চুনাপাথরের খাড়া পাহাড় এবং সবুজ বনভূমিকে জল থেকে উঠে আসা এক বিশাল কচ্ছপের মতো মনে করত। তাই তারা তাদের ভাষা আনিশিনাবেমোয়িন-এ এর নাম দিয়েছিল ‘মিচিলি ম্যাকিন্যাক’ বা ‘মহান কচ্ছপের স্থান’।

১৭৮০ সালে ব্রিটিশ বাহিনী দ্বীপটির নাম সংক্ষিপ্ত করে এখানে একটি প্রতিরক্ষা দুর্গ স্থাপন করে। ১৮১২ সালের যুদ্ধের পর আমেরিকা ম্যাকিন্যাকের নিয়ন্ত্রণ নিলেও, এর আদিবাসী শেকড় অক্ষুণ্ন রয়েছে।

এরিক হেমনওয়ে, যিনি অ্যানিশনাবের একজন সদস্য এবং দ্বীপটিতে আদিবাসী ইতিহাস পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, বলেন, ‘ম্যাকিন্যাক দ্বীপ অ্যানিশনাবের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশিষ্ট স্থান। অ্যানিশনাবিক জনগোষ্ঠী এই স্ট্রেইটস-এ (লেক হিউরন এবং লেক মিশিগানকে সংযোগকারী জলপথ) রয়েছে, কেউ কেউ বলেন, সেই অনাদিকাল থেকে।’ 

তিনি আরও জানান, দ্বীপে প্রায় ৩ হাজার বছর পুরোনো বিপুল সংখ্যক আদিবাসী সমাধিস্থল আবিষ্কৃত হয়েছে। হেমনওয়ে বিডল হাউসের উন্নয়নেও কাজ করেছেন, যেখানে ২০২১ সালে খোলা হয়েছে ম্যাকিন্যাক আইল্যান্ড নেটিভ আমেরিকান মিউজিয়াম।

১৯ শতাব্দীর শেষের দিকে, ম্যাকিন্যাক দ্বীপ শিকাগো, ডেট্রয়েট এবং তৎকালীন সমৃদ্ধ মিডওয়েস্টের অন্যান্য অঞ্চলের ধনী শিল্পপতি পরিবারগুলোর জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়। গ্রীষ্মকালে তারা দ্বীপের নির্মল জলে বিশ্রাম নিতে এখানে ভিড় জমাতেন।

ম্যাকিন্যাকের ১৩৮ বছরের পুরোনো গ্র্যান্ড হোটেল তার স্বতন্ত্রভাবে সজ্জিত কক্ষ এবং বিশ্বের দীর্ঘতম বারান্দার জন্য সুপরিচিত। শিল্প যুগের আমেরিকার ‘গিল্ডেড এজ’-এর শেষ পূর্ণাঙ্গ কার্যক্ষম হোটেলগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। মিশিগানের গভর্নর গ্রেচেন হুইটমার সম্প্রতি ‘এক্স’-এ ( সাবেক টুইটার) এই দ্বীপটিকে এইচবিও-এর জনপ্রিয় সিরিজ ‘দ্য হোয়াইট লোটাস’-এর চতুর্থ সিজনের সম্ভাব্য চিত্রগ্রহণের স্থান হিসেবে প্রস্তাব করেছেন।

যদিও মজার ছলেই তিনি এই প্রস্তাবটি দেন, তবুও মোর্স ম্যাকিন্যাককে অতিরিক্ত পর্যটনমুখিতা থেকে দূরে রাখতে চান। তিনি বলেন, ‘আপনি যেখানে বাস করেন, তার জন্য আপনার অবশ্যই গর্ব করা উচিৎ; কিন্তু একই সময়ে আমি মানুষকে বলতে চাই না যে জায়গাটা কতটা দারুণ।’

ছবি: ম্যাকিন্যাক আইল্যান্ড ট্যুরিজম ব্যুরো

ম্যাকিন্যাকের ৮০ শতাংশ ভূমি ম্যাকিন্যাক আইল্যান্ড স্টেট পার্কের অন্তর্ভুক্ত। এখানে দর্শনার্থীরা প্রাচীন বনের মধ্যে হেঁটে বেড়াতে পারেন, সুউচ্চ চুনাপাথরের স্তম্ভের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন এবং দ্বীপের অন্যতম বিখ্যাত আকর্ষণ–৫০ ফুট প্রশস্ত ‘আর্ক রক’ এর ছবি তোলার জন্য পায়ে হেঁটে, বাইকে করে অথবা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে পারেন।

দ্বীপের একমাত্র গ্রাম থেকে উত্তরে গিয়ে ৮ দশমিক ৫ মাইল দীর্ঘ হাইওয়েটিকে সাইকেল ও হাইকিং ট্রেইলে পরিণত করা হয়েছে। এটি দ্বীপের পরিধি বরাবর বিস্তৃত এবং পাঁচ মাইল দীর্ঘ ম্যাকিন্যাক সাসপেনশন ব্রিজের মনোরম দৃশ্য, শান্ত নুড়ি পাথরের সৈকত ও বনভূমির দিকে যাওয়ার পথ করে দেয়।

ঘোড়া ছাড়াও, দ্বীপের ১ হাজার ৫০০টি ভাড়া করা সাইকেলই এখানকার বাসিন্দা ও পর্যটকদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। এই স্ব-চালিত পরিবহন ব্যবস্থা ইঙ্গিত দেয় যে, ম্যাকিন্যাকের বাসিন্দারা দেশের বাকি অংশের চেয়ে ভিন্ন গতিতে চলতে ভালোবাসেন।

তবে সাইক্লিং জনপ্রিয় হলেও, দ্বীপের শক্তি যোগানের ক্ষেত্রে ঘোড়াই মূল ভূমিকা পালন করে। হান্টার হোগলান্ড, যিনি আর্নল্ড ফ্রেটে কাজ করেন, সেই কোম্পানি ১৪০ বছর ধরে দ্বীপে ফেরি পরিষেবা চালাচ্ছে এবং প্রতি এপ্রিলে মিশিগানের আপার পেনিনসুলায় শীত কাটানো ঘোড়ার পাল ফিরিয়ে আনে। তিনি বলেন, ‘ঘোড়া ছাড়া এই জায়গাটা এমন হতো না।’ শীতকালে আনুমানিক ২০-৩০টি ঘোড়া দ্বীপে আবর্জনা সংগ্রহ, পার্সেল বিতরণ এবং অন্যান্য কাজে দ্বীপকে সচল রাখার জন্য রয়ে যায়।

স্ফটিক স্বচ্ছ জলে ঘেরা ম্যাকিন্যাক শীতকালে ম্যাকিন্যাকের জীবনধারা কিছুটা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে, যেহেতু বরফের স্তূপ ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়। তবে বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে ম্যাকিন্যাক জীবন্ত হয়ে ওঠে। গ্রামের রাস্তাগুলোতে ছড়িয়ে থাকা ডজন ডজন লাইলাক গাছ জুনে দ্বীপের জনপ্রিয় ১০ দিনের লাইলাক উৎসবের আগে ফুটতে শুরু করে।

পর্যটকরা ম্যাকিন্যাকের ফোর্ট হোমসে এবং গ্র্যান্ড হোটেলের কুপোলা বারে যায় উত্তর মিশিগানের রাতের আকাশের অবাধ দৃশ্য উপভোগ করতে। কিন্তু বেশিরভাগ পর্যটকদের জন্য, দ্বীপের চারপাশে সাইকেল চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ার পর, একটি আইসক্রিম বা ফাজ-এর টুকরো হাতে নিয়ে মেরিনার দৃশ্য দেখতে দেখতে উপভোগ করাই সেরা।

আর এই সব কিছুর মাঝে কোনো গাড়ির হর্ন বা ইঞ্জিনের শব্দ তাদের এই অভিজ্ঞতাকে নষ্ট করে না।