Sundarbans_mangroves_forest_bangladesh (1)
সুন্দরবন। ফাইল ছবি: ইউএনবি

গবেষকদের মতে, এমটি মডেল ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের উপযোগী স্থান নির্ধারণে সহায়ক হবে এবং পানি ব্যবস্থাপনায় টেকসই পাম্পিং সীমা নির্ধারণেও সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের তলদেশে, বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকায় পূর্বে অজানা ছিল এমন দুটি বিশাল মিঠাপানির উৎসের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষকরা বলছেন, লবণাক্ততা-কবলিত এই অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট নিরসনে এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

গবেষণাটি গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র ডেল্টার (জিবিডি) দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পশুর নদী বরাবর পরিচালিত হয়। এখানে ভূগর্ভের বৈদ্যুতিক রোধের পার্থক্য শনাক্ত করতে গভীর-সেন্সিং ম্যাগনেটোটেলুরিক (এমটি) প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।

‘বেরিড ডিপ ফ্রেশওয়াটার রিজার্ভস বিনিথ স্যালিনিটি-স্ট্রেসেস’ [লবণাক্ততার চাপে মাটির গভীরে চাপা পড়া মিঠাপানির উৎস] শীর্ষক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, জরিপে ভূ-পৃষ্ঠের শত শত মিটার নিচে ‘আর১’ ও ‘আর২’ নামে দুটি বৃহৎ মিঠাপানির স্তর চিহ্নিত হয়েছে।

গবেষকদের মতে, এর মধ্যে বড়টি ‘আর১’ জরিপ লাইনের উত্তরে অবস্থিত এবং প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত; এর গভীরতা প্রায় ৮০০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছে। দ্বিতীয়টি, ‘আর২’, তুলনামূলকভাবে অগভীর ও ছোট; এটি সুন্দরবনের কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত এবং অনুরূপ দৈর্ঘ্যে অনুভূমিকভাবে বিস্তৃত হলেও গভীরতা সর্বোচ্চ ২৫০ মিটার পর্যন্ত।

বিজ্ঞানীরা এই সংরক্ষিত পানিকে ‘প্যালিওওয়াটার’ বা ‘প্রাচীন পানি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। হাজার হাজার বছর আগে ‘লাস্ট গ্লেশিয়াল ম্যাক্সিমাম’ বা শেষ বরফ যুগের সময় যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কম ছিল, তখন এই মিষ্টি পানি মাটির নিচে জমা হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় এই জলাধারের ওপর মিহি কাদা ও শক্ত মাটির স্তর জমে প্রাকৃতিকভাবে ‘সিলগালা’ হয়ে গেছে, যা নোনা পানির মিশ্রণ থেকে একে রক্ষা করেছে।

সদ্য আবিষ্কৃত এই গভীর জলাধারগুলো উপকূলীয় সাধারণ ভূগর্ভস্থ পানির চেয়ে আলাদা। কারণ এগুলো প্রাচীন ও ভিন্ন পরিবেশগত পরিস্থিতিতে গঠিত হয়েছিল। এগুলো অত্যন্ত ধীরগতিতে পুনঃভরাট হয়। তাই একে নবায়নযোগ্য উৎসের চেয়ে একটি ‘সীমিত ভূতাত্ত্বিক সম্পদ’ হিসেবেই দেখছেন বিজ্ঞানীরা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির বড় অংশই বর্তমানে লবণাক্ততার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, চিংড়ি চাষ এবং ভূ-উপরিস্থ পানির মৌসুমী সংকটের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এছাড়া দেশের অনেক অভ্যন্তরীণ এলাকায় অগভীর স্তরের পানিতে আর্সেনিক থাকায় নিরাপদ পানির সরবরাহ আরও সীমিত হয়ে পড়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, এই দুই জলাধারের মাঝখানে ২০ কিলোমিটার-প্রস্থের একটি লবণাক্ত অঞ্চল রয়েছে, যার নাম ‘সি১’। সুন্দরবনের উত্তরাংশে অবস্থিত এই পরিবাহী স্তরটি শেষ বরফযুগে গঠিত পুরনো গঙ্গা নদীর খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে এই খাত সামুদ্রিক পলি ও লবণাক্ত পানিতে ভরে উঠে এবং দুই মিঠাপানির স্তরের মাঝখানে প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে রয়ে যায়।

গবেষকদের ভাষ্য, এই আবিষ্কার উপকূলীয় বাংলাদেশের ভূগর্ভে মিঠাপানি ও লবণাক্ত পানির বিন্যাস সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা দেয়। এমটি মডেল ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের উপযোগী স্থান নির্ধারণে সহায়ক হবে এবং পানি ব্যবস্থাপনায় টেকসই পাম্পিং সীমা নির্ধারণেও সাহায্য করবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রাচীন ওঠানামা ও নদীখাতের ক্ষয়ের ফলে বিশ্বব্যাপী অন্যান্য উপকূলীয় বদ্বীপেও একই ধরনের গভীর জলাধার থাকতে পারে—এই গবেষণা সেসব ক্ষেত্রেও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করতে পারে।