প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন আছেন তারা?

huilceyaare_bse_deyaal_likhchen_pusspitaa_cedhurii

চট্টগ্রামের এক বিশেষায়িত স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মো. তাফসিরুল্লাহর। তিনি একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে এখন স্নাতকোত্তর পড়ছেন। কথাগুলো মাত্র কয়েকটি বাক্যে বলা যায় খুব সহজে। তবে মাঝখানের যে দীর্ঘ সংগ্রামী পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে, তা কিন্তু মোটেই সহজ নয়।

বিশেষ স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে এসে সাধারণ স্কুল-কলেজের ঝক্কি, শিক্ষা উপকরণের তীব্র সংকট আর চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা অবহেলা—সব সামলাতে হয়েছে তাকে। তবে হার না মানার দৃঢ় মানসিকতা একদিন তাকে পৌঁছে দিল ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র’ তোরণে। তিনি ভেবেছিলেন, এবার বুঝি কিছুটা ‘মুক্তি’ মিললো। 

“যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, বিশেষ করে সাংবাদিকতা বিভাগে, তখন প্রত্যাশাটা বড় ছিলো। যেহেতু আগে অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ এখানে পড়ে গেছেন, ভেবেছিলাম স্কুল-কলেজের সেই সংগ্রামটা আর থাকবে না”, বললেন তাফসিরুল্লাহ। তখনও তিনি জানেন না, তার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন বাস্তবতা! 

একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে অন্তত ১২ বছর স্কুল-কলেজের ধাপ পেরোতে হয়। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সেই পথটা অনেক বেশি কণ্টকময়। তবু তাফসিরুল্লাহর মতো তাদের অনেককেই থামানো যায় না। তারা পা রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই মুহূর্তে তাদের চোখে স্বপ্ন—এবার হয়তো কষ্টের দিন শেষ হবে, সম্মান পাবেন, আর পাবেন শেখার সমান সুযোগ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের স্বপ্নপূরণের পথে কতটা ভূমিকা রাখে?

আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে দেশে উচ্চ শিক্ষার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সংগ্রাম জানার চেষ্টা করেছি আমরা।

নিজেদেরই করতে হয় সব ব্যবস্থা

টাঙ্গাইলে স্কুল-কলেজ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন পুষ্পিতা চৌধুরী। কিন্তু একদিনের জন্যও তিনি আবাসিক হলে থাকতে পারেননি। কারণ, তাকে হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয়, এবং তার মত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নেই। 

অন্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মত তাকেও নিজের সকল কাজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। ডিপার্টমেন্ট, হল অফিস কিংবা রেজিস্টার ভবনের প্রশাসনিক কাজকর্ম, সবকিছুতে নিজেকেই খুঁজতে হয় সাহায্যকারী। পুষ্পিতার মতে, এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সেসব প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, যাদের পরীক্ষার সময় শ্রুতিলেখক দরকার হয়। 

তাফসিরুল্লাহ বলছিলেন সে অভিজ্ঞতার কথা। শ্রুতিলেখক সন্ধান করতে গিয়ে তার মনে হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বড় ‘বিপদে’ পড়েছেন তিনি! “শ্রুতিলেখক খোঁজার ব্যাপারটি খুবই প্যাথেটিক। ডিপার্টমেন্ট কিংবা ইউনিভার্সিটি, এ ব্যাপারে কেউ কোনো সাহায্য করেন না। অথচ তাদের স্ট্রং গাইডলাইন ঠিকই আছে”, বললেন তাফসিরুল্লাহ, “করোনার মধ্যে আমার বিভাগ একবারও জিজ্ঞেস করেনি আমি কীভাবে শ্রুতিলেখক জোগাড় করবো।” 

নিজেদের ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে অনেকেই আর শ্রুতিলেখক হিসেবে আসতে চান না বলে জানালেন তিনি। ড. মো. শাহরিয়ার হায়দারের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বিষয়ে দীর্ঘ গবেষণা ও একাডেমিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর অধ্যাপক। 

তিনি মনে করেন, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাহায্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বাড়তি কিছু পদক্ষেপ নিতে পারতো। বললেন, “বিশ্ববিদ্যালয় আগে থেকেই একটি শ্রুতিলেখক প্যানেল তৈরি করে রাখতে পারত, যেখান থেকে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনমাফিক পরীক্ষার সময় শ্রুতিলেখক দেওয়া যেত, কিন্তু তা করা হচ্ছে না।”

হলে থাকতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই সাবলেট বাসায় থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন পুষ্পিতা। তিনি মনে করেন, তার পরিবারের সামর্থ্য আছে বলে এভাবে থাকতে পারছেন, কিন্তু যাদের নেই, তারা বিপদে পড়ে যান। 

তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু তাদের ভর্তি নিয়েছে, যাবতীয় সুবিধা-অসুবিধাও কর্তৃপক্ষের দেখার কথা। “আমি কোথায় থাকবো, কীভাবে ৪-৫ তলায় উঠবো, কে আমাকে সাহায্য করবে, এসব ভাবলে পড়াশোনাটা করবো কখন?”, প্রশ্ন পুষ্পিতার।

পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়নে উপেক্ষা

শিক্ষকেরা সহানুভূতিশীল, এটা স্বীকার করে অনেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক বলছেন, পাঠ্যক্রম তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দিকটা উপেক্ষিত থাকে। 

বিশেষ করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে কোনো আলাদা নির্দেশনা না থাকায় তারা প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হন। অনেক সময় তাদের খাতায় গ্রাফ না থাকলে বা বানান ভুল হলে নম্বর কেটে দেওয়া হয়, অথচ এ ধরনের সীমাবদ্ধতা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাদের খাতা বিশেষভাবে মূল্যায়নের জন্য আলাদা কোনো কাঠামো নেই। কোনো শিক্ষক খাতার উপরে ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী’ লিখে বিবেচনা করলেও তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ।

অনেকে সচিত্র বা গ্রাফ–ভিত্তিক প্রশ্নের পরিবর্তে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাখ্যামূলক বিকল্প প্রশ্ন রাখেন, কারণ শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে গ্রাফ আঁকানো কার্যকরী নয়। তবে এটিও শিক্ষকদের বিবেচনার ওপরেই নির্ভরশীল। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালায় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য নির্ধারিত নির্দেশিকাতেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নপত্র তৈরি বা শিক্ষণ পদ্ধতি বিষয়ে কোনো আলাদা দিকনির্দেশনা নেই। কেবল ২০২২ সালে পাশ হওয়া একটি নীতিমালায় বলা আছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের প্রতি ঘণ্টার পরীক্ষায় ১০ মিনিট অতিরিক্ত সময় দিতে হবে। তবে তা বাস্তবে প্রয়োগের জন্য মাঝেমাঝে শিক্ষার্থীকে নিজেই বারবার অনুরোধ করতে হয় বলে জানান তারা।

বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ডিপার্টমেন্টগুলো যখন কোর্সের আউটলাইন তৈরি করে, তখন প্রতিবন্ধীদের কথা ভাবা হয় না বলে মনে করেন তাফসিরুল্লাহ। তিনি বলেন, “আমার ডিপার্টমেন্টে একটা কম্পিউটার কোর্স ছিল, নিউজ পেপার এডিটিং এর ওপর আলাদা কোর্স ছিল। আমি আমাদের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললাম, আমাকে তো শেখানো হচ্ছে না। তখন তিনি বললেন, আমাকে কীভাবে শেখাবেন তা তিনি জানেন না! তিনি আমাকে নিজে নিজে শিখতে বললেন।” 

তিনি আরও বললেন, “আমরা যেহেতু অন্যদের চেয়ে আলাদা, তাহলে শেখা আর মূল্যায়ন কেন আলাদা হবে না?”

ড. মো. শাহরিয়ার হায়দারও একই কথা বললেন। “প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কীভাবে পড়ানো দরকার, এ বিষয়ে আলাদা কোনো প্রভিশন রাখা হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ে; এটি শিক্ষকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকরা তো জানেন না যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী থাকলে ক্লাসে আলাদা কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এটি তো আসলে একটি মানবাধিকারের বিষয়, কিন্তু আমরা এখন এটিকে চ্যারিটি হিসেবে দেখি। অনেকে মনে করেন, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারছে, এটাই অনেক।”

শিক্ষকদের ‘হাউ টু টিচ’ বা পেডাগজি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দরকার বলে মনে করেন তিনি। “আইসিটির মতো একটি বিষয় যদি মৌখিকভাবে পরীক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে একজন শিক্ষার্থী কী শিখবে? অথচ তাদের জন্য স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার র‍য়েছে। কিন্তু ওই আইসিটি শিক্ষক হয়তো এগুলোর ব্যবহার জানেন না,” যোগ করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রিসোর্স সেন্টার’-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪১ জন, যাদের অধিকাংশই ১ শতাংশ কোটার আওতায় ভর্তি হয়েছেন। এই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অনেকেই বলছেন, তারা যে অন্যদের মতই সমানতালে লেখাপড়া শিখতে পারেন, অনেক শিক্ষকের কাছেই বিষয়টি নতুন।

অবকাঠামোই যেখানে বড় বাধা

পুষ্পিতার সেদিন পরীক্ষা ছিল। কলাভবনের পাঁচ তলায় পরীক্ষাকেন্দ্র। কিন্তু তখন বিদ্যুৎ নেই, ফলে লিফট বন্ধ। লিফট ছাড়া ওপরে ওঠা পুষ্পিতার জন্য একরম অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেদিন অন্যরা ধরে তাকে হুইলচেয়ারসহ পাঁচতলায় তোলেন বলেই পরীক্ষা দিতে পেরেছিলেন পুষ্পিতা।

‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফিজিক্যালি-চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন’ (ডিউপিডিএফ) এর আহ্বায়ক মোহাম্মদ তন্ময় আহমেদের মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো একদমই ‘ডিজেবল স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি’ না। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক সহায়তায় কাজ করে তার সংগঠন। 

তিনি বলেন, “প্রতিবছর ভালো সংখ্যক শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হন। কিন্তু প্রতি পদে পদে অবকাঠামাগত বাধার সম্মুখীন হন তারা। রেজিস্ট্রার ভবনের মত জায়গায় কোনো লিফট নেই, র‍্যাম্পগুলো খুবই চাপা। টিএসসির অংশ হবার সুযোগ তাদের নেই, কারণ এখানেও নেই লিফট। অনেক ভবনে দরজায় থাকে চৌকাঠ, ফলে হুইল চেয়ার নিয়ে প্রবেশ করাও কঠিন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অনেক বেশি উন্মুক্ত বলেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত অসম্ভব রকম কঠিন হয়ে পড়ে বলে তিনি মনে করেন। তবে আরও একটি সমস্যার কথা বেশ জোর দিয়ে বললেন, যা নিয়ে কর্তৃপক্ষ খুব কমই ভাবে। 

তন্ময় জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ভবনের এক তলা ছাড়া অন্যকোথাও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্যবহারযোগ্য কোনো ওয়াশরুম নেই। ফলে যেখানেই ক্লাস-পরীক্ষা হোক, একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে আসতে হবে সমাজবিজ্ঞান ভবনে। 

এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললেন পুষ্পিতা। “বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ওয়াশরুম ব্যবহার করে বের হই, আবার বাসায় ফেরার পর ব্যবহার করি। এটা যেমন মানসিক চাপ, তেমনই শারীরিকভাবেও ক্ষতিকর আমার জন্য। আমরা ব্যবহার করতে পারি এমন ওয়াশরুম নেই বিধায় এভাবেই চলতে হচ্ছে”, বললেন পুষ্পিতা।

তিনি জানালেন, প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও টিএসসির কোনো সংগঠনের অংশ তিনি হতে পারেননি। কারণ সেক্ষেত্রে অন্যের সাহায্যের ওপর ভরসা করতে হতো তাকে। তবে এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবনা খুবই কম। 

“মল চত্বর এত বড় একটি জায়গা, অথচ একপাশে একটি মাত্র র‍্যাম্প করা। মানে আমাকে যেতে হলে পুরোটা ঘুরে যেতে হবে। অথচ চাইলে সব পাশেই ঢালু করে ডিজাইন করা যেতো”, বলেন পুষ্পিতা।

সময়ের চেয়ে পিছিয়ে থাকা রিসোর্স সেন্টার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে ‘দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রিসোর্স সেন্টার’ নামে একটি ইউনিট থাকলেও সেটি পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকায় তা শিক্ষার্থীদের খুব বেশি উপকারে আসছে না। সরেজমিনে দেখা যায়, গুটিকয়েক কম্পিউটার, একটি শেলফে কিছু ব্রেইল বই, একটি বড় স্ক্রিন আর কিছু সরঞ্জাম নিয়ে ছোট একটি কক্ষ। একটি ব্রেইল প্রিন্টার রয়েছে, যা ২০১৩ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাতের দানে কেনা হয়েছিল।

সেন্টারের প্রধান মো. মুজিবুর রহমান নিজেও একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তিনি বলেন, “আমাদের এখানে ব্রেইলে লেখা বই আছে। আমরা চাইলে যে কোনো বই বা নোট নিয়ে এলে তা ব্রেইলে ছাপিয়ে দিই। কিন্তু এখন ছাত্ররা আর ব্রেইল পড়তে চায় না। তারা ফোনে অডিওতেই পড়া শুনে নেয়।” 

তবে সকল বিভাগের ব্রেইল বইও এখানে নেই। দশটির কাছাকাছি বিভাগের কিছু বই এখানে পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে সেন্টারের প্রধান জানান দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা সাধারণত কলা বা সামাজিক বিজ্ঞানের কিছু বিভাগেই বেশি পড়েন, ফলে সেগুলোই এখানে রাখা আছে। তবে ব্রেইলে বই ছাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলেও শিক্ষার্থীরা খুব কমই সেই সুবিধা নেয় বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে তাফসিরুল্লাহ জানান, “ব্রেইলের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিও রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা রিসোর্স সেন্টারে কম যায় কারণ তারা যথেষ্ট উপকার পায় না। সময়ের সাথে সবকিছুরই আধুনিকায়ন দরকার।”

রিসোর্স সেন্টার শিক্ষার্থীদের উপকারে না আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার বিভাগে আমি ২য় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। আমার বিভাগের একটিমাত্র ব্রেইল বই পেয়েছিলাম। কদিন পরে গিয়ে সেটিও খুঁজে পাইনি। তারা অডিও আকারে বই রাখার ও শোনার ব্যবস্থা রাখলে একসাথে যেমন অনেক বই রাখতে পারতো, শিক্ষার্থীরাও বেশি উপকৃত হত।”

মো. মুজিবুর রহমান বলেন রিসোর্স সেন্টার প্রায়শই ফাঁকা পড়ে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সুবিধা বাড়ানোর ব্যাপারে প্রশ্ন করলে মো. মুজিবুর রহমান বলেন, “সুবিধার তো কোনো শেষ নাই। আমরা ব্রেইলে বই বাঁধিয়ে দেবো, আর কী চান? আরও কিছু চাইলে সেই দাবিগুলো তাদেরই আনতে হবে। তারা আমাদেরকে এসে নিজেদের সমস্যা জানাক আমরা তখন দেখবো।” 

আইন আছে, প্রয়োগ নেই

২০১৩ সালের ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন’-এ ‘রিজনেবল অ্যাকোমোডেশন’ নামে একটি বিষয় উল্লেখ আছে। অর্থাৎ, যতটুকু ন্যায্য, ততটুকু সুবিধা সমন্বয় করে দিতে হবে। 

অধ্যাপক হায়দারের মতে এ সুবিধা অনেক রকম হতে পারে। যেমন—হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী কোনো শিক্ষার্থীর ক্লাস যদি কোনো বিভাগের তৃতীয় তলায় হয়, তবে লিফটে তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। লিফট না থাকলে, এমন শিক্ষার্থীর জন্য ওই ক্লাসটি নিচতলায় নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এগুলোই রিজনেবল অ্যাকোমোডেশন। 

আরও আছে, যেমন—পরীক্ষায় অতিরিক্ত সময় দেওয়া। প্রিন্ট করা উপকরণের সাথে তাদের জন্য রেকর্ড করা উপকরণও দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে অধিকারভিত্তিক করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মানতে হবে। ডাকসুতে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে এবং জাতীয় সংসদেও কোটা থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। 

তবে কাগজে-কলমে আইন থাকলেও শুধু কোটায় ভর্তি করানোতেই যেন দায় মিটে যায় দেশের সর্বপ্রাচীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও স্বীকার করছে, এখানে নীতিগত শূন্যতা রয়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদকে সমস্যাগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “অন্তর্ভূক্তির কোনো শেষ নেই, আরও সুবিধার দরকার হলে লিখিত দাবি নিয়ে আসতে হবে।” 

“না জানালে তো কিছুই হবে না। আমাদের কাছে লিখিত নিয়ে আসেন, আমরা তখন নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেগুলো নিয়ে কাজ করবো। সমস্যা বলছেন, সমাধানের জন্য আপনারা কিছু করছেন না কেন?”, পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি।

তবে যাদের জন্য নীতিমালা তৈরি হওয়ার কথা, দায়িত্ব কি সত্যিই শুধু তাদের ওপরেই বর্তায়? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বড় একটা প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি বিষয় নজরে আসা সব সময় সম্ভব হয় না। আপনারা লিখিত দাবি নিয়ে আসেন, আমরা কাজ করবো।”