ভরা মৌসুমেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কমেছে পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি

তীব্র শীত ও খাদ্য সংকট থেকে বাঁচতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে আসে এসব পরিযায়ী পাখি। শীত শেষে বসন্তে তারা পুনরায় ফিরে যায় নিজ আবাসে। একসময় এই পাখিদের অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

18 DEC WEB
ছবি : অরিত্র সাত্তার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শীতকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসের অন্যতম আকর্ষণ হলো এর মনোরম জলাশয় ও পরিযায়ী পাখি। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একসময় এসব জলাশয়ের শাপলা পাতায় পাখিদের জলকেলি আর ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কলরবে মুখর হয়ে উঠত পুরো ক্যাম্পাস। মাত্র কয়েক বছর আগেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র ছিল এমনই, কিন্তু বর্তমানে তা কেবলই অতীতের স্মৃতি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত বহুতল ভবন নির্মাণে নির্বিচারে গাছ নিধন, যথাসময়ে জলাশয় সংস্কার না করা এবং মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়াসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গত তিন বছর ধরে ক্যাম্পাসে অতিথি পাখির দেখা মিলছে না।

তীব্র শীত ও খাদ্য সংকট থেকে বাঁচতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে আসে এসব পরিযায়ী পাখি। শীত শেষে বসন্তে তারা পুনরায় ফিরে যায় নিজ আবাসে। একসময় এই পাখিদের অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচিত হতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ক্যাম্পাসে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০টি জলাশয় রয়েছে। ১৯৯০ সালের দিকে ক্যাম্পাসে প্রথম পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে এবং শুরুর দিকে প্রায় প্রতিটি জলাশয়েই এদের আনাগোনা ছিল। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও গাছ কাটার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় ধীরে ধীরে কমতে থাকে অতিথিদের সংখ্যা। বর্তমানে ক্যাম্পাসের একটি সংরক্ষিত জলাশয় ছাড়া আর কোথাও পাখির দেখা পাওয়া দুষ্কর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্যমতে, ক্যাম্পাসে আসা পাখিদের বেশিরভাগই হাঁস জাতীয়। এর মধ্যে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইক্যাচার, গার্গেনি, পাতারি হাঁস, জলচর পাখি, খয়রা ও কম্ব ডাক বা নক্টা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া মানিকজোড়, কলাই, ছোট নাগ, জলপিপি, খঞ্জনা, চিতা টুপি, রেড গুরগুটি, বামুনিয়া হাঁস, নর্দার্ন পিনটেইল এবং সিকল-ক্রেস্টেডসহ আরও নানা প্রজাতির পাখি দেখা যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাখির সংখ্যা কমার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো: লেকগুলোর সংস্কার না করা, অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ, খাদ্য সংকট এবং নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব। এছাড়া শব্দ ও আলো দূষণ এবং মানুষের ভিড় পাখির স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত আচরণ তাদের নিরাপত্তাবোধ নষ্ট করছে। পাশাপাশি লেকের পানি দূষণ, জলপ্রবাহে বাধা এবং পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ফলে পাখিরা বাধ্য হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আমীর হোসেন ভূইয়া বলেন, ‘গত আট–দশ বছর ধরে অতিরিক্ত পর্যটন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত্রতত্র অটোরিকশা ও যানবাহনের শব্দ, মানুষের হৈচৈ, ছবি তোলা এবং ঢিল বা খাবার ছোড়ার মতো আচরণের কারণে পাখিরা নিরাপদ বোধ করছে না।’

‘পাখি কমে যাওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো খাদ্য সংকট। আগে লেকের পানি স্বচ্ছ ছিল, যেখানে প্ল্যাঙ্কটন, পোকামাকড় ও ছোট মাছের মতো পাখির প্রয়োজনীয় খাবার পাওয়া যেত। বর্তমানে পানির গুণগত মান নষ্ট হয়েছে এবং দূষণ বেড়েছে। এক লেকের সাথে আরেক লেকের সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহ বা ‘ওয়াটারফ্লো’ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে ছোট প্রাণীর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা পাখিদের খাদ্যাভাব তৈরি করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনও এর ওপর বড় প্রভাব ফেলছে। আগে বাংলাদেশের হাওড়-বিলে প্রচুর পরিযায়ী পাখি দেখা যেত। এখন টাঙ্গুয়ার হাওড়ের মতো জায়গাতেও পাখির সংখ্যা কমেছে। সেচ কাজের জন্য বাঁধ দেওয়ায় পানির প্রবাহ কমেছে, ফলে পাখির প্রয়োজনীয় গাছপালা ও খাদ্য তৈরি হচ্ছে না। হাকালুকি হাওড়েও পানি প্রায় নেই। এসব কারণে পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশকে আর আগের মতো নিরাপদ মনে করছে না।’

ছবি : অরিত্র সাত্তার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


পাখির সংখ্যা কেন কমছে?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর আগেও ক্যাম্পাসে প্রায় ৬-৭ হাজার পরিযায়ী পাখি আসত। গত তিন বছরে এই সংখ্যা কমে ২,৫০০-৩,০০০-এ নেমে এসেছে। চলতি বছর তা আরও কমে ২০০০-এর কোঠায় দাঁড়িয়েছে। গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে ডব্লিউআরসি লেক, ট্রান্সপোর্ট চত্বর ও আল-বেরুনী হল সংলগ্ন লেকে পাখি বসলেও, এবার শেষের দুটি লেকে পাখির দেখা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. কামরুল হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন অ্যান্ড স্টাডি সেন্টার (ডব্লিউআরসি)-এর ভেতরের লেকে গত ১৩ অক্টোবর প্রথমবারের মতো প্রায় ৩০–৩৫টি পাখির একটি ঝাঁক নামে এবং অক্টোবরের শেষ নাগাদ লেকটি পাখিতে ভরে যায়। এবার মাত্র দুটি লেকেই অতিথি পাখি বসেছে। ডব্লিউআরসি লেক ছাড়াও সম্প্রতি জয়পাড়া লেকটি পরিষ্কার করায় সেখানেও কিছু পাখি বসছে।’

তিনি আরও জানান, ‘করোনাকালীন নীরব সময়ে (২০১৯–২০) ডিসেম্বরের পিক টাইমে সব লেক মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার পাখি গণনা করা হয়েছিল। সাধারণ সময়ে এই সংখ্যা ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ পর্যন্ত থাকত। কিন্তু গত কয়েক বছরে তা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। বর্তমানে জাবি সামগ্রিকভাবে এক ধরনের ‘ইকোলজিক্যাল ডিক্লাইন’ বা বাস্তুতান্ত্রিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখিরা।’

বহিরাগত প্রবেশ ও নানামুখী হুমকি

জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার’ (ডব্লিউআরসি)। দীর্ঘ সময় ধরে এই স্থানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন কেয়ারটেকার সানোয়ার হোসেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ডব্লিউআরসি জলাশয়ে প্রতিবছরই পাখিরা জলকেলিতে মেতে ওঠে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের কলকাকলি শোনা যায়। কিন্তু বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এখানে শিক্ষার্থী ও বহিরাগত দর্শনার্থীদের আনাগোনা বেড়েছে। অনেকে অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করছেন, ফলে পাখিরা হুমকির মুখে পড়ছে।’

তিনি আরও জানান, ‘ডব্লিউআরসি-এর সামনের জয়পাড়া লেকে সকালে পাখির দেখা মিললেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকসমাগম বাড়ে। পাখিদের ভয় দেখানো বা ঢিল ছোড়ার কারণে তারা অন্যান্য লেকে স্বাভাবিকভাবে বিচরণ করতে পারছে না।’

সংরক্ষণে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও আলোকচিত্রী অরিত্র সাত্তার দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসের বন্যপ্রাণী ও পরিযায়ী পাখি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘গত বছর প্রাণিবিদ্যা বিভাগ প্রায় ৩,০০০ পরিযায়ী পাখির তথ্য নথিভুক্ত করেছিল, যার বেশির ভাগই ছিল ডব্লিউআরসি সংলগ্ন লেকে। প্রশাসনিক ভবন ও পরিবহন চত্বর সংলগ্ন লেকে প্রায় ৫০০ পাখি বসত, যা এ বছর প্রায় শূন্যের কোঠায়।’

এ বছর সরেজমিনে ডব্লিউআরসি ও সুইমিংপুল সংলগ্ন লেক পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সেখানে গ্লসি আইবিস (খয়রা কাস্তেচরা), ফুলভাজ হুইসলিং ডাক (রাজ সরালি), লেসার হুইসলিং ডাক (পাতি সরালি) ও গার্গেনি প্রজাতির পাখি এসেছে। এছাড়া দেশীয় শামুকখোল বা এশিয়ান ওপেন বিল এবং শিকারি পাখির মধ্যে চেঞ্জেবল হক ঈগল ও ওরিয়েন্টাল হানি বাজার্ড দেখা গেছে। সাময়িক সময়ের জন্য গ্রেটার স্পটেড ঈগল, ইন্ডিয়ান স্পটেড ঈগল ও বুটেড ঈগলেরও দেখা মিলেছে।

অরিত্র আরও বলেন, ‘এখন আমরা যে পাখিগুলো দেখছি, সেগুলো মূলত তৃতীয় বা চতুর্থ ধাপে (ওয়েভ) আসা পাখি। এগুলো শুধু ডব্লিউআরসি লেকেই আসছে, কারণ সেখানে মানুষের কৃত্রিম কার্যক্রম নেই এবং প্রাকৃতিকভাবে পুকুরটিকে ঠিক রাখা হয়েছে।’

ছবি : অরিত্র সাত্তার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

পাখিদের নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ বিষয়ে অধ্যাপক আমীর হোসেন ভূইয়া বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি লেককে পৃথকভাবে বিবেচনায় নিয়ে একটি স্থায়ী ও টেকসই ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে মনিটরিং প্রোগ্রাম চালু করা জরুরি। মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ, পানি ও জঙ্গল এলাকার সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং পাখির স্বাভাবিক আবাসস্থল রক্ষার মাধ্যমেই প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’

সরেজমিনে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে প্রশাসন লেক পরিষ্কার ও পাখির জন্য মাচা তৈরির উদ্যোগ নিলেও, এ বছর শীত মৌসুমে তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহযোগিতায় প্রশাসন কেবল একটি জলাশয় পরিষ্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

লেক সংস্কার ও পাখির উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট শাখার কর্মকর্তা আব্দুর রব বলেন, ‘লেক খনন ও পাখি সংরক্ষণের জন্য আমাদের যে বাজেট দেওয়া হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। ছাত্রজীবনে আমরা যেসব বৈচিত্র্যময় পাখি দেখতাম, আজ সেগুলো দুর্লভ। নতুন ভবন নির্মাণ, বাড়তি মানুষের চাপ, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক এবং অবাধ বিচরণের কারণে পাখির আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া পাখির আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত লেকগুলোও ঠিকমতো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। পাখির সংখ্যা কমার দায় আমাদের অবশ্যই আছে।’

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘গত কয়েক দিনে দেখা যাচ্ছে পাখি ধীরে ধীরে আবার আসতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করলে ক্যাম্পাসে পূর্বের সেই পরিবেশ কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।’