পৃথিবীর সবচেয়ে ভূতুড়ে ৭ জায়গা
পৃথিবীর সবচেয়ে ভূতুড়ে ৭ জায়গা
ভয়েরও বেশ কদর আছে! ভূতুড়ে বা অলৌকিক স্থান দেখার জন্য মানুষ পকেটের পয়সা খরচ করতেও ছাড়ে না। আজকাল বিভিন্ন উৎসবের সময় যে ‘ভুতুড়ে বাড়ি’ তৈরি করা হয়, সেগুলো নিছকই মজার জন্য এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ।
কিন্তু আমরা আজ যে জায়গাগুলোর কথা বলব, সেগুলো কোনো বানানো ভয়ের জায়গা নয়। এগুলো আসল। এই স্থানগুলো সত্যিই অদ্ভুত, রহস্যময় এবং গা ছমছমে।
১. সেডলেক ওসুয়ারি – চেক প্রজাতন্ত্র
সেডলেক ওসুয়ারি হলো চেক প্রজাতন্ত্রের একটি ছোট রোমান ক্যাথলিক গির্জা। কিন্তু এর বিশেষত্ব হলো, গির্জার ভেতরটা প্রায় ৪০,০০০ মানুষের কঙ্কাল দিয়ে সাজানো। মানুষের হাড় দিয়ে বানানো বিভিন্ন নকশা দেখলে অবাক হতে হয়!

সেডলেক ওসুয়ারি, যা সিমেট্রি চার্চ অফ অল সেন্টসের নীচে অবস্থিত একটি ছোট ক্যাথলিক চ্যাপেল, সেখানে ৪০,০০০ থেকে ৭০,০০০ মানুষের কঙ্কাল রয়েছে বলে মনে করা হয়। ছবি : ব্র্যান্ডন মার্শাল
গির্জার ঠিক মাঝখানে ঝুলছে মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি একটি বিশাল ঝাড়বাতি। আর একপাশে রয়েছে শোয়ার্জেনবার্গ পরিবারের প্রতীক, যা কিনা তৈরি হয়েছে মানুষের কঙ্কাল দিয়েই। ভাবুন তো, কেমন মনের মানুষ হলে কেউ মানুষের হাড়ের ঝাড়বাতি বানানোর কথা ভাবতে পারে?
তবে এর পেছনের কারণটা কিন্তু বেশ সাধারণ। আসলে জায়গার অভাবই ছিল মূল কারণ। ১২৭৮ সালে এই গির্জার প্রধান যাজক জেরুজালেম থেকে যিশুর সমাধিক্ষেত্র গোলগোথার মাটি নিয়ে আসেন। এরপর ইউরোপের হাজার হাজার মানুষ এখানে সমাধিস্থ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এতো মানুষের জায়গা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায়, পুরনো কবর খুঁড়ে কঙ্কালগুলো বের করে গির্জার ভেতরে সাজিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সীমিত জায়গায় কবর দেওয়ার জন্য এটি ছিল এক অদ্ভুত কিন্তু বাস্তব সমাধান।
২. বেল উইচ কেভ – টেনেসি, আমেরিকা
আমেরিকার টেনেসিতে অবস্থিত ‘বেল উইচ কেভ’ বা ডাইনির গুহা আপনাকে এক গা ছমছমে অনুভূতি দেবে। বলা হয়, ১৮০০-এর দশকে এখানে এক দুষ্ট ডাইনি বাস করত, যে বেল পরিবারকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।

টেনেসির অ্যাডামসের বেল উইচ গুহায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। ছবি : নিকোল হেস্টার/দ্য টেনেসিয়ান
এই ডাইনি বেল পরিবারের কর্তা জন বেলকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলে এবং তার মেয়ে বেটসির ওপরও অকথ্য অত্যাচার চালায়। প্রচলিত গল্প অনুসারে, সেই ডাইনি আসলে ছিল তাদেরই এক প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রতিবেশী, যার নাম কেট ব্যাটস।
এই গল্পটি টেনেসির একটি বিখ্যাত লোককথা এবং এটি নিয়ে সিনেমা ও উপন্যাসও লেখা হয়েছে। শোনা যায়, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন একবার এই জায়গায় এসে এতো ভয় পেয়েছিলেন যে তিনি বলেছিলেন, “ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হতে রাজি, কিন্তু বেল ডাইনির সাথে আর এক রাতও কাটাতে চাই না।”
৩. লা ইসলা দে লাস মুনেকাস (পুতুলের দ্বীপ) – মেক্সিকো
‘লা ইসলা দে লাস মুনেকাস’ বা পুতুলের দ্বীপ হলো এক অদ্ভুত ও ভুতুড়ে জায়গা। ডন জুলিয়ান সান্তানা নামের এক ব্যক্তি প্রায় ৫০ বছর ধরে এই দ্বীপে একাকী বাস করতেন। ২০০১ সালে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এক ভয়ঙ্কর সংগ্রহ তৈরি করেন।

মেক্সিকো সিটির ভয়াবহ পুতুল দ্বীপটি অনেককে ভয় পাইয়ে দেয়। ছবি : ইউরি কর্টেজ/এএফপি
তিনি ভাঙা, বিকৃত আর ভয়ংকর সব পুতুল জোগাড় করে দ্বীপের গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখতেন। আজও সেই পুতুলগুলো গাছের ডালে ঝুলে আছে, যেন কোনো ভয়ঙ্কর প্রথার অংশ। দেখতে ভয়ানক লাগলেও এর পেছনের গল্পটা কিন্তু বেশ করুণ।
শোনা যায়, ডন জুলিয়ান দ্বীপের পাশের খালে ডুবে যাওয়া এক ছোট্ট মেয়ের আত্মার জন্য এই পুতুলগুলো উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে মেয়েটির আত্মা শান্তি পাবে। তিনি কি সত্যিই সেই আত্মার সাথে কথা বলতেন, নাকি পুরোটাই তার কল্পনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার উদ্দেশ্য ছিল শুধু ভূতুড়ে বন্ধুটিকে কিছু খেলনা উপহার দেওয়া।
৪. ব্যাটলশিপ আইল্যান্ড – নাগাসাকি, জাপান
জাপানের নাগাসাকি উপকূলে অবস্থিত হাশিমার আর এক নাম ‘গানকানজিমা’ বা ব্যাটলশিপ আইল্যান্ড, কারণ দ্বীপটি দেখতে যুদ্ধজাহাজের মতো। এটি এখন কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

জাপানের নাগাসাকির কাছে হাশিমা দ্বীপে ভবনগুলি ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে, ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত থাকার পর এখন এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ছবি : কার্ল কোর্ট
১৯৫০-এর দশকে এই দ্বীপটি হাজার হাজার কয়লাখনি শ্রমিকের বাসস্থান ছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে কয়লাখনি বন্ধ হয়ে গেলে দ্বীপটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। পরিত্যক্ত দ্বীপের মধ্যে এমনিতেই একটা অশুভ ব্যাপার থাকে। এই দ্বীপে গেলে মনে হয়, আপনি যেন কোনো ভুতুড়ে জায়গায় আটকে পড়েছেন। এখানকার ভাঙা দালান আর খনি শ্রমিকদের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র দ্বীপটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ জায়গা করে তুলেছে।
দ্বীপটি ২০১২ সালের জেমস বন্ডের সিনেমা ‘স্কাইফল’-এ ভিলেনের গোপন ঘাঁটি হিসেবেও দেখানো হয়েছিল।
৫. ক্যাটাকম্বস – প্যারিস, ফ্রান্স
ভাবুন তো, আপনি প্যারিসের রাস্তার নিচে এক সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন আর আপনার চারপাশে শুধু মানুষের মাথার খুলি আর হাড়গোড়! শুনতে অদ্ভুত লাগলেও প্যারিসের অন্যতম ভুতুড়ে আকর্ষণ হলো এই ক্যাটাকম্বস।

ক্যাটাকম্বে ১৮ শতকের শেষ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যে প্রায় ষাট লক্ষ মানুষের দেহাবশেষ প্যারিসের অন্যান্য জায়গা না থাকা কবরস্থান থেকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ছবি : দিমিতর দিলকফ/এএফপি
এটি মেট্রো এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থারও অনেক গভীরে অবস্থিত, যেখানে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের কঙ্কাল রাখা আছে। অষ্টাদশ শতকে প্যারিসের কবরস্থানগুলোতে আর জায়গা না থাকায় এই সুড়ঙ্গগুলো তৈরি করা হয়েছিল। তবে এখানে ঘুরতে গেলে সাবধান! ২০১৭ সালে দুজন কিশোর এই গোলকধাঁধায় তিন দিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল।
৬. পোভেগ্লিয়া দ্বীপ – ভেনিস, ইতালি
ইতালির এই সুন্দর দ্বীপটির অতীত কিন্তু ভীষণ ভয়ঙ্কর। ১৭০০-এর দশকে এটি প্লেগ রোগীদের জন্য একটি কোয়ারেন্টাইন জোন ছিল। পরে, ১৯২০-এর দশকে, এখানে একটি মানসিক হাসপাতাল তৈরি করা হয়।

এই দুর্গম ইতালীয় দ্বীপের সৌন্দর্য আপনাকে বিভ্রান্ত করতে পারে, এটি একসময় প্লেগ আক্রান্তদের জন্য কোয়ারেন্টাইন জোন ছিল। ছবি: মার্কো সেচি
শোনা যায়, এই দ্বীপে হাসপাতালের রোগীদের অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। কিংবদন্তি অনুসারে, হাসপাতালের এক নিষ্ঠুর ডাক্তার রোগীদের ওপর অত্যাচার করত এবং শেষে নিজেই অনুশোচনায় গির্জার চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। সেই ভাঙা, মরচে পড়া ভবনটি এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, যা দেখলেই গা ছমছম করে। এই দ্বীপে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ, তবে কিছু পর্যটককে ভেনিসের নৌকাচালকরা লুকিয়ে সেখানে নিয়ে যায় বলে শোনা যায়।
৭. দারভাজা ক্রেটার বা নরকের দরজা – তুর্কমেনিস্তান
হ্যাঁ, পৃথিবীতে সত্যিই এমন একটি গর্ত আছে যা তুর্কমেনিস্তানের মরুভূমিতে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাউদাউ করে জ্বলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এর নাম দারভাজা ক্রেটার হলেও, এটি ‘গেটওয়ে টু হেল’ বা ‘নরকের দরজা’ নামেই বেশি পরিচিত।

এই গর্তটি ১৯৭১ সালে তৈরি হয়েছিল এবং মিথেন গ্যাসের বিস্তার রোধ করার জন্য এর কিছুক্ষণ পরেই আগুন লাগানো হয়েছিল এবং তখন থেকেই এটি জ্বলছে। ছবি : জাইলস ক্লার্ক
এই আগুনের গর্তটি কীভাবে তৈরি হলো, তার কোনো সঠিক তথ্য নেই, যা এটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। বলা হয়, ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিকরা তেলের সন্ধানে এসে প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি ভাণ্ডার খুঁজে পান। মিথেন গ্যাসের বিস্তার ঠেকাতে তারা সেখানে আগুন ধরিয়ে দেন, যা আজও জ্বলছে। মরুভূমির মাঝে এই জ্বলন্ত গর্তটি এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। যদিও বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর আগুন ধীরে ধীরে নিভে আসছে।