টেসলা, আমাজন, এনভিডিয়ার জোর প্রচেষ্টা…হিউম্যানয়েড রোবট কি তবে আসছেই?

পাথরের তৈরি কৃত্রিম মানুষ থেকে শুরু করে আধুনিক সায়েন্স ফিকশন কিংবা ড্রাইভারহীন গাড়িরোবট নিয়ে মানুষের আগ্রহ বরাবরই প্রবল। বর্তমানে হিউম্যানয়েড রোবট ঘিরে যে উন্মাদনা, তার বড় অংশই মাস্কের কারণে।

258187_are_humanoid_robots_just_hype_or_are_they_coming_cvirginia-1
ছবি: ক্যাথ ভার্জিনিয়া/দ্য ভার্জ

রোবটের ব্যর্থতার ভিডিও অনেকের কাছেই বিনোদনের খোরাক। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টেসলার ‘অপটিমাস’ রোবটের একটি ভিডিও ঘিরে বেশ আলোচনা চলছে। মিয়ামিতে টেসলার ‘অটোনমি ভিজুয়ালাইজড’ ইভেন্টে রোবটটিকে একটি গাছের মতো হুড়মুড় করে পড়ে যেতে দেখা যায়।

ফুটেজে দেখা যায়, ইলন মাস্কের বহুল প্রচারিত এই হিউম্যানয়েড রোবটটি একটি টেবিলের পেছন থেকে পানির বোতল দিচ্ছিল। হঠাৎ করেই সে কয়েকটি বোতল উল্টে ফেলে এবং ভারসাম্য হারিয়ে পেছনের দিকে পড়ে যায়। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রোবটটির পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিটি এমন ছিল, যেন কেউ তার মাথা থেকে একটি ভিআর  হেডসেট খুলে ফেলছে।

টেসলার স্বয়ংক্রিয় রোবটের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। মাস্ক এই রোবটকে কোম্পানির ভবিষ্যতের মূল ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরলেও বহুবার এর ‘স্বয়ংক্রিয়’ হওয়ার দাবি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। শুরুর দিকের এক প্রদর্শনীতে দেখা গিয়েছিল, আসলে টাইট পোশাক পরা একজন মানুষ রোবটের অভিনয় করছিল। পরবর্তী প্রদর্শনীগুলোতেও প্রমাণ মিলেছে, আড়াল থেকে মানুষ ভিআর হেডসেটের মাধ্যমে রোবটগুলোকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

পাথরের তৈরি কৃত্রিম মানুষ থেকে শুরু করে আধুনিক সায়েন্স ফিকশন কিংবা ড্রাইভারহীন গাড়ি—রোবট নিয়ে মানুষের আগ্রহ বরাবরই প্রবল। বর্তমানে হিউম্যানয়েড রোবট ঘিরে যে উন্মাদনা, তার বড় অংশই মাস্কের কারণে। তবে এক কোটি নয়, বরং ১০ লক্ষ রোবটের একটি ‘সেনাবাহিনী’ তৈরির যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, তার বাস্তবতা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই সন্দিহান। অতীতে দেখা গেছে, প্রযুক্তি প্রায়ই মানুষের প্রত্যাশার তুলনায় পিছিয়ে থাকে—যদিও এখন দাবি করা হচ্ছে, প্রযুক্তি নাকি পুরোপুরি প্রস্তুত।

বর্তমান পরিস্থিতি

বর্তমানে হিউম্যানয়েড রোবট তৈরিকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে এক তীব্র প্রতিযোগিতা। এনভিডিয়া, মেটা, সফটব্যাঙ্ক, গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, ইন্টেল এবং টেসলার মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এই খাতে বিপুল অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করছে। একই সঙ্গে অ্যাপট্রোনিক, বোস্টন ডায়নামিক্স, ফিগার এআই এবং ওয়ানএক্স-এর মতো নতুন কোম্পানিও এই প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে।

চীনও এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই। বেইজিংয়ের ধারণা, রোবোটিক্স ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রই হবে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। বিপুল বিনিয়োগ ও সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে চীন নিজেকে এই খাতে বিশ্বনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। চলতি বছরের গ্রীষ্মে দেশটিতে প্রথমবারের মতো ‘ওয়ার্ল্ড হিউম্যানয়েড রোবট গেমস’ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে রোবটগুলো নাচ, লড়াই এবং দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য এখন রোবটকে কারখানার গণ্ডি পেরিয়ে ঘরের কাজে নিয়ে আসা। ‘ফিগার ০৩’ রোবটকে থালাবাসন ধোয়া ও কাপড় ভাঁজ করার মতো কাজ করতে দেখা গেছে। ওয়ানএক্স তাদের ‘নিও’ রোবটকে বিশ্বের প্রথম ভোক্তা-বান্ধব হিউম্যানয়েড রোবট হিসেবে দাবি করছে, যা আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে ২০ হাজার ডলারে বিক্রি শুরু হবে।

তবে বাস্তবে এসব রোবটের ব্যবহার এখনো খুব সীমিত। অনেক ক্ষেত্রেই প্রদর্শনীগুলো আগেভাগে সাজানো থাকে অথবা দূর থেকে মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন, ওয়ানএক্সের ‘নিও’ রোবটটি ঘরে আনার অর্থ হলো—ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূর থেকে কোনো একজন মানুষ সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করে আপনার ঘরের কাজ করে দেবে। অর্থাৎ রোবটগুলো এখনো পুরোপুরি নিজে থেকে কাজ করতে সক্ষম হয়নি।

রোবট বিপ্লবকে ঘিরে তথ্য তৈরির একটি নতুন শিল্পও গড়ে উঠছে। ভারতে এমন কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে শ্রমিকদের শরীরে ক্যামেরা লাগিয়ে কাপড় ভাঁজ করার মতো কাজ করানো হচ্ছে, যাতে সেই তথ্য দিয়ে রোবটকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়।

গুগল ডিপমাইন্ড এমন একটি এআই মডেল তৈরি করছে, যা থ্রিডি পরিবেশ সৃষ্টি করে রোবট প্রশিক্ষণে সহায়তা করবে।

গত মাসে রাশিয়ার একটি হিউম্যানয়েড রোবটের মঞ্চে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়।

ভবিষ্যতে যা হতে পারে

ঐতিহাসিকভাবে, রোবটের জন্য হাঁটা কিংবা এক গ্লাস পানি তোলার মতো সাধারণ কাজও ছিল অত্যন্ত কঠিন। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের সীমাবদ্ধতায় এগুলো কেবল নির্দিষ্ট কিছু কাজেই সীমাবদ্ধ থাকত। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের উন্নতির ফলে এই চিত্র ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে।

চ্যাটবট তৈরিতে ব্যবহৃত লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম) যেভাবে কাজ করে, সেই একই পদ্ধতিতে রোবটকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে বড় বাধা হলো তথ্যের ঘাটতি। চ্যাটবট শেখাতে ইন্টারনেট থেকে বিপুল পরিমাণ লেখা ও ছবি পাওয়া গেলেও, বাস্তব জগতের নড়াচড়া সংক্রান্ত তথ্য তুলনামূলকভাবে খুবই কম। সে কারণে কোম্পানিগুলো এখন মানুষকে ক্যামেরা ও সেন্সর পরিয়ে বিভিন্ন কাজ করাচ্ছে, যাতে সেই তথ্য রোবটকে শেখানো যায়।

বর্তমানে হিউম্যানয়েড রোবটের দামও কমতে শুরু করেছে, বিশেষ করে চীনে। এন্ট্রি-লেভেলের মডেলগুলোর দাম ১ হাজার ৪০০ থেকে ২০ হাজার ডলারের মধ্যে। যত বেশি মানুষ রোবট ব্যবহার করবে, কোম্পানিগুলো তত বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে এবং রোবটগুলোও তত দ্রুত উন্নত হবে।

তবে এত উন্নতির পরও অনেকের ধারণা, এটি একটি সীমিতি পরিসর হয়ে উঠতে পারে। খোদ চীনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, হিউম্যানয়েড রোবট খাতে অতিরঞ্জিত বিনিয়োগ হচ্ছে, কিন্তু বাস্তব জীবনে এর কার্যকর ব্যবহার এখনো সীমিত। রোবটগুলো পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় না হওয়ায় শৌখিন ব্যবহারকারী বা গবেষক ছাড়া সাধারণ মানুষ কেন এটি কিনবে—সে প্রশ্নও উঠছে। ঘরের কাজের জন্য আপাতত একজন মানুষ নিয়োগ করাই রোবট কেনার চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী।

রোবট আদৌ বিপ্লব ঘটাতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। ততদিনে হয়তো আমাদের আরও অনেক রোবটের ব্যর্থতার ভিডিও দেখতে হবে।