‘অ্যালজেবরা’ থেকে ‘ট্যারিফ’: ইংরেজি ভাষায় ঢোকা অসংখ্য আরবি শব্দ
সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে আরবি সবচেয়ে বেশি কথিত ভাষা। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায় এই ভাষাগোষ্ঠীর উৎপত্তি। শত শত বছর ধরে আরবি ভাষা বিভিন্ন সমাজ ও অন্য ভাষাকে প্রভাবিত করে আসছে। ভাষাবিদরা বলেন, অন্য ভাষায় আরবি শব্দের উপস্থিতি দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে এই যোগাযোগ গড়ে উঠেছে।
‘অ্যালজেবরা’ থেকে ‘ট্যারিফ’: ইংরেজি ভাষায় ঢোকা অসংখ্য আরবি শব্দ
সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে আরবি সবচেয়ে বেশি কথিত ভাষা। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায় এই ভাষাগোষ্ঠীর উৎপত্তি। শত শত বছর ধরে আরবি ভাষা বিভিন্ন সমাজ ও অন্য ভাষাকে প্রভাবিত করে আসছে। ভাষাবিদরা বলেন, অন্য ভাষায় আরবি শব্দের উপস্থিতি দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে এই যোগাযোগ গড়ে উঠেছে।
বিশ্বের অন্যতম বহুল প্রচলিত ভাষা আরবি। বর্তমানে কমপক্ষে ৪০ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। এর মধ্যে ২০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা আরবি। আর বাকি ২০ থেকে ২৫ কোটি মানুষ দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে এটি ব্যবহার করেন।
সরকারি কাজকর্ম, আইন-আদালত ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ‘মডার্ন স্ট্যান্ডার্ড অ্যারাবিক’ বা আধুনিক প্রমিত আরবি ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রেও এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাজুড়ে ২৫টিরও বেশি আঞ্চলিক ভাষায় মানুষ কথা বলে।
প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ‘বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস’ পালন করে। তারা আরবি ভাষাকে ‘মানবতার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্তম্ভ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। ১৯৭৩ সালের এই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আরবিকে তাদের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষার একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাই এই দিনটিকে উদযাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে।
আল জাজিরার এই প্রতিবেদনে ইংরেজি ভাষার এমন কিছু প্রচলিত শব্দ তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলো আরবি থেকে এসেছে। অথবা ইংরেজিতে আসার আগে আরবি ভাষার মধ্য দিয়ে এসেছে।
আরবি শব্দ যেভাবে অন্য ভাষায় প্রবেশ করেছে
সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে আরবি সবচেয়ে বেশি কথিত ভাষা। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায় এই ভাষাগোষ্ঠীর উৎপত্তি। শত শত বছর ধরে আরবি ভাষা বিভিন্ন সমাজ ও অন্য ভাষাকে প্রভাবিত করে আসছে।
ভাষাবিদরা বলেন, অন্য ভাষায় আরবি শব্দের উপস্থিতি দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে এই যোগাযোগ গড়ে উঠেছে।

ইলাস্ট্রেশন: আল-জাজিরা
ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফরাসি, তুর্কিসহ বিশ্বের অনেক ভাষায় শত শত বা হাজার হাজার আরবি শব্দ ঢুকে পড়েছে। এসব শব্দ এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ও ভাষাবিদ মুনতাসির আল হামাদ একে ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ বলেছেন। তিনি বলেন, শতাব্দী ধরে এক ভাষা অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করে আসছে।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আরবিও এর ব্যতিক্রম নয়। শব্দভান্ডার, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সভ্যতায় এর প্রতিফলন দেখা যায়।’
এক বর্ণমালা, বহু রূপ
আরবি বর্ণমালায় ২৮টি অক্ষর রয়েছে। এটি ডান দিক থেকে বাম দিকে লেখা হয়। এর লিপি পেঁচানো প্রকৃতির। শব্দের কোথায় বসছে, তার ওপর ভিত্তি করে অক্ষরের আকার পরিবর্তিত হয়। সাধারণ লেখায় সাধারণত হ্রস্ব স্বরবর্ণ বা হরকত ব্যবহার করা হয় না।
এসব বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি আরবিতে শব্দের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। তাই অনেকেই মনে করেন, বিদেশিদের জন্য এই ভাষা শেখা কঠিন। তবে আল হামাদ বলেন, অনেক মানুষের ক্ষেত্রে এই ধারণা মোটেও সঠিক নয়।

আরবি বর্ণমালা। ছবি: আল-জাজিরা
তিনি বলেন, ‘আরবি সম্পর্কে অন্যতম বড় ভুল ধারণা হলো, এটি বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন ভাষাগুলোর একটি। বাস্তবে এটি কেবল এমন একটি ভাষা যার নিয়মকানুন ইংরেজি বা অনেক ইউরোপীয় ভাষা থেকে আলাদা।’
তিনি আরও বলেন, কিছু শিক্ষার্থীর কাছে আরবি লিপি অপরিচিত মনে হতে পারে। তবে উর্দু ও ফারসি ভাষাভাষীদের কাছে এটি ‘বেশ পরিচিত’। আল হামাদের মতে, এই ভাষার মানুষরা সহজেই আরবি পড়তে পারেন। অন্যদিকে তুর্কি ভাষায় হাজার হাজার আরবি শব্দ রয়েছে। তাই তুর্কি ভাষাভাষীদের জন্য আরবি শব্দ মুখস্থ করা সহজ হতে পারে।
‘অ্যালজেবরা’ থেকে ‘ট্যারিফ’
গণিত ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরবি ভাষা বিশ্বের বুকে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব শব্দের কিছু সংক্ষিপ্ত বা পরিবর্তিত রূপে অন্য ভাষায় প্রবেশ করেছে। শব্দগুলো এখন এতটাই পরিচিত হয়ে গেছে যে, মানুষ এর উৎস সম্পর্কে ভুলেই গেছে।
এর একটি উদাহরণ হলো গণিতের ভিত্তি ‘অ্যালজেবরা’ বা বীজগণিত। শব্দটি আরবি ‘আল-জাবর’ থেকে এসেছে। এর অর্থ ‘পুনর্গঠন’ বা ‘পুনর্মিলন’। নবম শতাব্দীতে বাগদাদের পারসিক পণ্ডিত মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি সমীকরণ সমাধানের ওপর একটি বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ের শিরোনামে শব্দটি প্রথম দেখা যায়। উল্লেখ্য, ‘অ্যালগরিদম’ শব্দটিও এই আল-খাওয়ারিজমির নাম থেকেই এসেছে।
অন্য অনেক আরবি শব্দে আরও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন রত্নপাথরের ওজন মাপার একক ‘ক্যারাট’। এই শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘কিরাত’ থেকে।

ছবি: আল-জাজিরা
আল হামাদের মতে, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষা কীভাবে অপরিচিত শব্দকে নিজেদের করে নেয়, এই পরিবর্তনগুলো তা প্রকাশ করে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘ইংরেজিতে কিউ (Q) দিয়ে শুরু হওয়া শব্দের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তাই ‘কিরাত’-এর মতো আরবি শব্দগুলোকে সি (C), জি (G) বা কে (K)-এর মতো পরিচিত ধ্বনি দিয়ে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে। এর ফলেই ‘ক্যারাট’-এর মতো শব্দের সৃষ্টি হয়েছে।’
বিজ্ঞান ও গণিতের বাইরে দৈনন্দিন শব্দভান্ডারেও একই প্রক্রিয়া দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে ‘জিরাফ’ শব্দটির কথা বলা যায়। এটি আরবি ‘জারাফা’ থেকে এসেছে। ইংরেজি ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় আসার সময় এর মূল ধ্বনি পরিবর্তিত হয়েছে। তারা নিজেদের উচ্চারণের সুবিধার জন্য শব্দটি বদলে নিয়েছে, ঠিক যেমনটা ‘কিউ'(Q) দিয়ে শুরু হওয়া আরবি শব্দের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
অন্যদিকে ‘ট্যারিফ’ বা শুল্ক শব্দটি আরবি ‘তা’রিফ’ থেকে এসেছে। এর অর্থ ‘জানানো’ বা ‘ঘোষণা করা’। বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত অন্য ভাষার সংস্পর্শে এসে এটি ইংরেজিতে প্রবেশ করেছে।
আল হামাদ বলেন, এই শব্দগুলো সম্ভবত রোমান্স ভাষাগুলোর মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করেছে। তবে আজকের পরিচিত রূপে হয়তো তখন ছিল না। তিনি আরও বলেন, তুর্কি ভাষার মাধ্যমেও কিছু শব্দ এসেছে। তুর্কি ভাষা আরবি থেকে প্রচুর শব্দ ধার করেছিল। আবার ব্যবসা ও যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় বিশ্বকে প্রভাবিত করেছিল তারা। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ইংরেজি ভাষা সরাসরি আরবি থেকে শব্দ গ্রহণ করেছে এবং আরবিতেও শব্দ দিয়েছে।