যে ৭ প্রাচীন ভাষার পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি

আধুনিক প্রযুক্তির এত জয়জয়কার সত্ত্বেও বেশ কিছু প্রাচীন লিখনপদ্ধতি আজও মানুষের কাছে এক দুর্ভেদ্য রহস্য হয়ে আছে। এসব লিপি আমাদের এক উন্নত সভ্যতার গল্প শোনায় ঠিকই, কিন্তু সেই ভাষা বোঝার সাধ্য আমাদের নেই।

ezgif-1ceec399cfb957fc
ছবি: একেজি ইমেজেস

ধাঁধা মেলাতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু যদি এমন হয়, আপনার সামনে একটি ভিনদেশি গোপন সংকেত রাখা হলো যার পাঠোদ্ধার করতে হবে, কিন্তু তার ব্যাকরণ বোঝার কোনো নির্দেশিকা নেই, নেই কোনো অভিধানও; তখন কী করবেন?

ঠিক এমনই এক পরিস্থিতির মুখোমুখি বর্তমান বিশ্বের প্রত্নতত্ত্ববিদ আর ভাষাবিজ্ঞানীরা। আধুনিক প্রযুক্তির এত জয়জয়কার সত্ত্বেও বেশ কিছু প্রাচীন লিখনপদ্ধতি আজও মানুষের কাছে এক দুর্ভেদ্য রহস্য হয়ে আছে। এসব লিপি আমাদের এক উন্নত সভ্যতার গল্প শোনায় ঠিকই, কিন্তু সেই ভাষা বোঝার সাধ্য আমাদের নেই।

জার্মানির কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ সভেনিয়া বোনমান। তার গবেষণার মূল বিষয় এই প্রাচীন ভাষাগুলোর জট খোলা এবং সেগুলোর কাঠামো নতুন করে তৈরি করা।

নিজের কাজ নিয়ে সভেনিয়া বলেন, ‘এমন কঠিন বুদ্ধির ধাঁধার মুখোমুখি হওয়াটা আমার কাছে খুবই রোমাঞ্চকর, যা আজ পর্যন্ত বিশ্বের তীক্ষ্ণতম মেধাগুলোর পক্ষেও সমাধান করা সম্ভব হয়নি।’ তার মতে, এই প্রাচীন লিপিগুলো যেন এক একটি ‘টাইম মেশিন’। এগুলো আমাদের বহু আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

রহস্যময় সেই সব লিপি

সভ্যতার ইতিহাস মানেই এগিয়ে যাওয়ার গল্প। কিন্তু সেই গল্পের সবটুকু আমাদের জানা নেই। মেক্সিকোর উপকূল থেকে সিন্ধু নদের অববাহিকা কিংবা চিলির রহস্যময় ইস্টার আইল্যান্ড—সবখানেই ছড়িয়ে আছে এমন কিছু প্রাচীন লিপি, যার পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছে বাঘা বাঘা ভাষাবিজ্ঞানীদের।

সভেনিয়া বোনমান বর্তমানে কাজ করছেন মেক্সিকোর দক্ষিণ উপকূলে একসময় প্রচলিত ‘এপি-ওলমেক’ লিখনপদ্ধতি নিয়ে। প্রাচীন মেক্সিকোর এই লিপিগুলো গবেষকদের জন্য এক কঠিন ধাঁধা। কিছু প্রতীক বা সংকেত দেখে একে একটি উন্নত লিখনপদ্ধতি মনে হলেও মুশকিলটা অন্য জায়গায়। 

বোনমান জানান, এই লিপিতে লেখা নিদর্শনের সংখ্যা এতই কম যে একে কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা প্রায় অসম্ভব। পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে এই সভ্যতার মানুষ ঠিক কী বলতে চেয়েছিল, তা আজও অজানাই রয়ে গেছে।

আমাদের এই অঞ্চলের সিন্ধু সভ্যতার (হারাপ্পান সভ্যতা) লিপির রহস্যও কম নয়। বর্তমান ভারত ও পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত এই প্রাচীন জনপদের কয়েকশ সিলমোহর আর মাটির পাত্রে বিচিত্র সব চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। 

কিন্তু সমস্যা হলো, প্রতিটি লেখা বা সংকেত খুবই সংক্ষিপ্ত। গবেষকদের মধ্যে এই লিপি নিয়ে তুমুল বিতর্ক রয়েছে, যে এটি কি আসলেই কোনো পূর্ণাঙ্গ ভাষা, নাকি স্রেফ বিশেষ কিছু প্রতীকের সমষ্টি—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই কেটে গেছে কয়েক দশক।

ছবি: ইম্যাগো

চিলির ইস্টার আইল্যান্ডে আবিষ্কৃত ‘রঙ্গোরঙ্গো’ লিপি তো আরও বিস্ময়কর। এখানকার কাঠের ফলকগুলোতে পাখি, মানুষ কিংবা বিচিত্র সব বাহারি নকশার আদলে প্রতীক খোদাই করা হয়েছে। তবে এমন লিপিখচিত কাঠের ফলক পাওয়া গেছে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি, যার অনেকগুলো আবার সময়ের বিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে এই বিমূর্ত চিহ্নগুলোর আড়ালে ঠিক কোন তথ্য লুকিয়ে আছে, তা উদ্ধার করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

গ্রিসের ক্রিট দ্বীপের মিনোয়ান সভ্যতা সম্পর্কে গবেষকদের হাতে অনেক তথ্য থাকলেও তাদের লিখনপদ্ধতি এখনো এক গোলকধাঁধা। এই সভ্যতার তিনটি প্রধান লিখনপদ্ধতির মধ্যে কেবল ‘লিনিয়ার বি’র পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, যা মূলত প্রাচীন গ্রিক ভাষার একটি প্রাথমিক রূপ। কিন্তু ‘ক্রিটান হায়ারোগ্লিফিক’ এবং ‘লিনিয়ার এ’ আজও বিজ্ঞানীদের কাছে এক দুর্ভেদ্য রহস্য।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ক্রিট দ্বীপে পোড়ামাটির একটি চাকতি আবিষ্কৃত হয়, যা ‘ফাইস্টোস ডিস্ক’ নামে পরিচিত। প্রায় ৩ হাজার ৭০০ বছর পুরনো এই চাকতিতে সর্পিল আকারে অদ্ভুত সব চিহ্ন খোদাই করা আছে। ধারণা করা হয়, কাঁচা মাটিতে বিশেষ কোনো সিলমোহর দিয়ে ছাপ দিয়ে এগুলো তৈরি করা হয়েছিল। চাকতিটি অনন্য এবং এর মতো দ্বিতীয় কোনো নিদর্শন আর কোথাও পাওয়া যায়নি—আর ঠিক এই কারণেই এর পাঠোদ্ধার করা একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মধ্য ইতালির প্রাচীন ভাষা ‘এট্রুস্কান’ নিয়ে এক অদ্ভুত সংকটে পড়েছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। গ্রিক বর্ণমালা থেকে আসায় এই লিপির বর্ণগুলো অনায়াসেই পড়া যায়। কিন্তু সমস্যা হলো এর অর্থ নিয়ে। এই ভাষার সঙ্গে চেনা কোনো ভাষা পরিবারের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে বর্ণগুলো চিনতে পারলেও পাথরের ফলকগুলোতে ঠিক কী লেখা আছে, তা বুঝতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমান ইরানের প্রাচীন জনপদ এলামে একসময় প্রচলিত ছিল ‘প্রোটো-এলামাইট’ লিপি। এটি মূলত প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হতো। এই লিপির চিহ্নগুলো গবেষকেরা তালিকাভুক্ত করতে পারলেও গোল বেঁধেছে অন্য জায়গায়। এখানকার মাটির ফলকগুলো বেশির ভাগই ভাঙা বা খণ্ডিত। এই লিপির সঙ্গেও পরিচিত কোনো ভাষারই মিল নেই। ফলে প্রাচীন ইরানের এই প্রশাসনিক নথিগুলো আজও অনেকটা বোবা হয়েই রয়ে গেছে।

প্রয়োজন ‘রোসেটা স্টোন’

এই সব রহস্যময় লিপির পাঠোদ্ধার করতে না পারার পেছনে একটি বড় কারণ হলো—একটি ‘রোসেটা স্টোন’-এর অভাব। অষ্টাদশ শতকে আবিষ্কৃত এই বিখ্যাত পাথরখণ্ডটিতে একই বয়ান তিনটি ভিন্ন ভিন্ন লিপিতে খোদাই করা ছিল। ফলে গবেষকেরা চেনা প্রাচীন গ্রিক ভাষার সূত্র ধরে অজানা মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিকের মর্মার্থ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। এমন কোনো ‘মাস্টার কি’ বা চাবিকাঠি ছাড়া বর্ণ বা শব্দের ধ্বনিগত রূপ আর ব্যাকরণ বোঝা প্রায় অসম্ভব।

তবে গবেষক সভেনিয়া বোনমান মনে করেন, চাবিকাঠি ছাড়াও পাঠোদ্ধার অসম্ভব নয়। এর বড় প্রমাণ ‘লিনিয়ার বি’। তার মতে, ‘আপনার সব সময় একটি দ্বিভাষিক বার্তার প্রয়োজন নেই। এর বদলে ইতিহাসের ধারাবাহিকতাটা বুঝতে পারা জরুরি। যেমন কোনো অঞ্চলের নাম কিংবা তৎকালীন রাজা বা দেবতাদের নাম। এমন কোনো সূত্র হাতে এলে রহস্যের জট খোলা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।’ 

কিন্তু মুশকিল অন্য জায়গায়। অনেক ক্ষেত্রে নিদর্শনের সংখ্যা এতই কম এবং বাক্যগুলো এত ছোট যে কোনো সুনির্দিষ্ট ধাঁচ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এর ওপর আবার আছে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বিড়ম্বনা। 

বোনমান বলেন, ‘আমাদের সব সময় অতীতের ভাঙাচোরা ধুলোমাখা কিছু টুকরো নিয়ে কাজ করতে হয়।” ইউরোপে এ ধরনের গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত রসদ থাকলেও মধ্য আমেরিকায় পরিস্থিতি ভিন্ন। স্প্যানিশ দিগ্বিজয়ীরা মেক্সিকো বা তৎসংলগ্ন এলাকায় ইতিহাসের যেটুকু অংশ ধ্বংস করা থেকে বাদ রেখেছেন, গবেষকদের এখন সেই সামান্য টুকরো সম্বল করেই পথ চলতে হচ্ছে।

বোনমান আরও ব্যাখ্যা করেন যে কোনো অস্পষ্ট ভাষাকে পাঠোদ্ধারের জন্য সেটিকে একটি চেনা ‘ভাষা পরিবারের’ অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। যদি সেই ভাষার কোনো উত্তরসূরি বা নিকটাত্মীয় ভাষা খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে তার ধ্বনিগত গঠন বা ব্যাকরণের ধরন মেলানোর জন্য কোনো নির্দিষ্ট ছক পাওয়া যায় না। আর তখনই থমকে যায় সব প্রচেষ্টা।

ছবি: পিকচার অ্যালিয়েন্স

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি পারবে জট খুলতে?

বর্তমানে রহস্যময় সংকেত বা কোড ভাঙার কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-এর ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। এআই খুব দ্রুত অক্ষরের বিন্যাস শনাক্ত করতে পারে, বিভিন্ন পাঠের মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারে, এমনকি কোনো প্রাচীন লিপির নষ্ট হয়ে যাওয়া অংশ কেমন হতে পারে, তারও একটা খসড়া তৈরি করতে পারে।

তবে সভেনিয়া বোনমান মনে করেন, প্রাচীন লিপির ক্ষেত্রে এআই-এরও একটি বড় সীমাবদ্ধতা আছে। এআই মূলত বিশাল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। কিন্তু প্রাচীন লিপিগুলোর ক্ষেত্রে তথ্যের পরিমাণ এতই নগণ্য যে তা দিয়ে এআই-কে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। 

তিনি বলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে এমন কোনো প্রোগ্রাম তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম, যা এত অল্প তথ্য নিয়ে নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারবে।’

তা ছাড়া, সভেনিয়া মনে করেন, এআই নতুন করে কিছু ‘চিন্তা’ করতে পারে না। এটি কেবল আগে থেকে জানা তথ্যের নানা ধরনের বিন্যাস তৈরি করে বুদ্ধিমত্তার একটি ভ্রম তৈরি করে মাত্র। 

এর ফলে অনেক সময় এআই এমন কিছু ব্যাখ্যা দাঁড় করায় যা দেখতে খুব চমৎকার ও যৌক্তিক মনে হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে তার কোনো ভিত্তি থাকে না। আরেকটি ভয়ের ব্যাপার হলো, গবেষকদের অবচেতন মনের প্রত্যাশা বা পক্ষপাত অনেক সময় এআই-এর ফলাফলে প্রতিফলিত হতে পারে। যেমন, এআই হয়তো এমন দুটি ভাষার মধ্যে সম্পর্ক ‘আবিষ্কার’ করে বসল যা আসলে গবেষণার তথ্যেই বারবার ঘুরেফিরে আসছিল, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই।

প্রাচীন এই লিপিগুলোর সম্ভবত এটাই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগেও অতীতের কিছু কণ্ঠস্বর আজও নিস্তব্ধ রয়ে গেছে—অন্তত এখন পর্যন্ত।

সভেনিয়া বোনমান বলেন, ‘যতদূর জানি, শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই ইতিহাসের বোধ আছে। আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং কোথায় যাচ্ছি—তা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ভাবি।’ তার কাছে অতীতের সমাজগুলো কেমন ছিল, তারা কেনই-বা হারিয়ে গেল—তা নিয়ে এই গভীর অনুসন্ধানই হলো মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়।