২০২৫ সালে সবচেয়ে বেশি সম্পদ হারানো ১০ ধনকুবের
২০২৫ সালে সবচেয়ে বেশি সম্পদ হারানো ১০ ধনকুবের
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)–নির্ভর বাজার উত্থানের ফলে ২০২৫ সাল বিশ্বের অনেক ধনকুবেরের জন্য ছিল লাভজনক। চলতি বছরের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ১৮ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। বছরের শুরুতে যারা ধনী ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই এখন আরও ধনী।
তবে এই আকাশচুম্বী সমৃদ্ধির ভিড়েও মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখা গেছে। ২০২৪ সালের শেষে তালিকায় থাকা ২,৭০০-এর বেশি বিলিয়নিয়ারের মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশই গত এক বছরে দরিদ্র হয়েছেন। এমনকি এই তালিকায় থাকা ৮৫ জন ব্যক্তি তাদের ‘বিলিয়নিয়ার’ তকমাটিই হারিয়ে ফেলেছেন।
সম্পদ হারানোর দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘হার্মিস’-এর পঞ্চম প্রজন্মের উত্তরাধিকারী নিকোলাস পুয়েচ। তার দাবি, হার্মিসে থাকা তার বিশাল অংকের শেয়ার রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছে।
পুয়েচ অভিযোগ করেছেন, তার প্রয়াত আর্থিক উপদেষ্টা তাঁর অগোচরেই সেই শেয়ারগুলো ফরাসি ধনকুবের বার্নার্ড আরনল্ট এবং তার বিলাসবহুল পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলভিএমএইচের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। যদিও আরনল্ট এবং এলভিএমএইচ উভয় পক্ষই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ২০২৪ সালের শেষে পুয়েচের সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪.৮ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল সম্পদ হারিয়ে তিনি এখন ফোর্বসের বিলিয়নিয়ারের তালিকা থেকেই বাদ পড়েছেন।
সামগ্রিকভাবে ২০২৫ সালে ৬৬০ জনেরও বেশি বর্তমান ও প্রাক্তন বিলিয়নিয়ারের সম্পদ কমেছে। তবে সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি পুয়েচের মতো রহস্যময় ছিল না। মূলত শুল্ক নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ সুদের হার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জগুলোই তাদের সম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিলেন ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের (১০১ জন), এরপর যথাক্রমে প্রযুক্তি (৮৯ জন) এবং ফ্যাশন ও রিটেইল (৭৭ জন)। দেশ হিসেবে লোকসানকারীদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (১৮৬ জন), এরপর ভারত (১০৯ জন) ও চীন (৯১ জন)।
মার্কিন বিলাসবহুল আসবাবপত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘রিস্টোরেশন হার্ডওয়্যার’-এর চেয়ারম্যান ও সিইও গ্যারি ফ্রিডম্যান এ বছর বড় লোকসানের মুখে পড়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কের প্রভাবে ২০২৫ সালে আরএইচ-এর শেয়ারের দাম কমেছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। এতে ফ্রিডম্যানের সম্পদ ১.২ বিলিয়ন ডলার কমে বর্তমানে ৮৫০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এপ্রিল মাসে ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর প্রতিষ্ঠানের আয় সংক্রান্ত এক সভায় হতাশায় ফেটে পড়ে ফ্রিডম্যান বলেছিলেন, “ওহ শিট!”। গত এক বছরে অনেক বিলিয়নিয়ারেরই সম্ভবত একই অনুভূতি হয়েছে।
নিচে ২০২৫ সালে সম্পদ হারানো আরও ১০ জন উল্লেখযোগ্য ধনকুবেরের তথ্য দেওয়া হলো (২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী):
উইলিস জনসন
মোট সম্পদ: ২.৩ বিলিয়ন ডলার (২০২৫ সালে কমেছে ১ বিলিয়ন ডলার)
সম্পদের উৎস: ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি
নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্র
মহামারীর সময় ব্যবহৃত গাড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জনসনের অনলাইন নিলাম প্রতিষ্ঠান ‘কোপার্ট’ ব্যাপক লাভ করেছিল। তবে সেই সুবাতাস কমে আসায় মে মাসের তুলনায় কোপার্টের শেয়ারের দাম ৩০ শতাংশ পড়ে গেছে।
ই. জো শেন
মোট সম্পদ: ৩.৩ বিলিয়ন ডলার (কমেছে ১.১ বিলিয়ন ডলার)
সম্পদের উৎস: ইউ-হল
নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্র
মার্ক শেন
মোট সম্পদ: ৩.৯ বিলিয়ন ডলার (কমেছে ১.২ বিলিয়ন ডলার)
সম্পদের উৎস: ইউ-হল
নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্র
ইউ-হলে রেকর্ড আয় হওয়া সত্ত্বেও যানবাহনের অবচয় এবং পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে গত এক বছরে শেয়ারের দাম ২৬ শতাংশ কমেছে। এর ফলে চেয়ারম্যান জো শেন এবং সিইও মার্ক শেনের সম্মিলিত সম্পদ ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমেছে।
অ্যান্ড্রু বিলেকি
মোট সম্পদ: ২.৯ বিলিয়ন ডলার (কমেছে ১.২ বিলিয়ন ডলার)
সম্পদের উৎস: মার্কেটিং সফটওয়্যার
নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্র
বিলেকির সহ-প্রতিষ্ঠিত মার্কেটিং অটোমেশন সফটওয়্যার কোম্পানি ‘ক্ল্যাভিও’-র শেয়ার গত ফেব্রুয়ারিতে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। তবে বিনিয়োগকারীরা বাজেট সংকোচন এবং প্রতিযোগিতার কারণে প্রত্যাশা কমিয়ে আনলে শেয়ারের দাম প্রায় ২২ শতাংশ পড়ে যায়।
অ্যালবার্ট চাও, জেমস চাও, ডরোথি চাও জেনকিন্স ও তাদের পরিবার
মোট সম্পদ: প্রত্যেকের ২.৮ বিলিয়ন ডলার করে (প্রত্যেকে ১.৩ বিলিয়ন ডলার করে হারিয়েছেন)
সম্পদের উৎস: রাসায়নিক
নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্র
চাও ভাইবোনদের প্রত্যেকে তাদের বাবার প্রতিষ্ঠিত পেট্রোকেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েস্টলেক কর্পোরেশন’-এর ২৫ শতাংশের মালিক। বৈশ্বিক নির্মাণ এবং শিল্প চাহিদা কমে যাওয়ায় এ বছর কোম্পানির শেয়ারের দাম ৩৫ শতাংশ কমেছে।
জো মানসুয়েতো
মোট সম্পদ: ৫.৩ বিলিয়ন ডলার (কমেছে ১.৭ বিলিয়ন ডলার)
সম্পদের উৎস: বিনিয়োগ গবেষণা
নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্র
তিন দশক আগে মানসুয়েতো ‘মর্নিংস্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন। জেনারেটিভ এআই নিয়ে উদ্বেগের কারণে গত ছয় মাসে অনেক তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের সাথে মর্নিংস্টারের শেয়ারও প্রায় ৩৫ শতাংশ কমেছে।
টমাস হেগেন ও পরিবার
মোট সম্পদ: ৫.৬ বিলিয়ন ডলার (কমেছে ২.১ বিলিয়ন ডলার)
সম্পদের উৎস: বীমা
নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্র
হেগেন ও তাঁর পরিবার ‘ইরি ইন্স্যুরেন্স’ নিয়ন্ত্রণ করেন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে শেয়ারের দাম শীর্ষে থাকলেও তৃতীয় প্রান্তিকের আয় প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় এর ব্যাপক পতন ঘটে।
মাইকেল সেলার
মোট সম্পদ: ৫.২ বিলিয়ন ডলার (কমেছে ২.৪ বিলিয়ন ডলার)
সম্পদের উৎস: ক্রিপ্টোকারেন্সি
নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্র
সেলার তার কোম্পানি ‘স্ট্র্যাটেজি’ (সাবেক মাইক্রোস্ট্র্যাটেজি) এবং ব্যক্তিগতভাবে বিপুল পরিমাণ বিটকয়েন জমা করেছেন। বিটকয়েনের দাম বাড়ায় গত দুই বছরে শেয়ারের দাম দ্বিগুণ হয়েছিল। তবে বর্তমানে ক্রিপ্টো বাজারে মন্দা চলায় শেয়ারের দাম ৪৫ শতাংশ পড়ে গেছে, যা সেলারের সম্পদ কয়েক বিলিয়ন ডলার কমিয়ে দিয়েছে।
স্কট ফারকুহার এবং মাইক ক্যানন-ব্রুকস
মোট সম্পদ: ১১.২ বিলিয়ন ও ১১.৬ বিলিয়ন ডলার (যথাক্রমে ৩.৬ ও ৩.৭ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন)
সম্পদের উৎস: সফটওয়্যার
নাগরিকত্ব: অস্ট্রেলিয়া
‘অ্যাটলাশিয়ান’-এর এই দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা এ বছর বড় লোকসানের মুখে পড়েছেন। উচ্চ সুদের হার এবং বাজেট সংকটের কারণে গ্রাহকরা ক্লাউড সফটওয়্যার সেবা কমিয়ে দেওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ৩২ শতাংশ কমেছে।
জেফ টি গ্রিন
মোট সম্পদ: ২.৬ বিলিয়ন ডলার (কমেছে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার)
সম্পদের উৎস: ডিজিটাল বিজ্ঞাপন
নাগরিকত্ব: যুক্তরাষ্ট্র
গ্রিনের প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ট্রেড ডেস্ক’ মহামারীকালীন ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের জোয়ারে ব্যাপক লাভ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞাপন খাতে মন্দার কারণে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন। এ বছর সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দর ৬৮ শতাংশ কমেছে।
ম্যানুয়েল ভিলার
মোট সম্পদ: ৪.৮ বিলিয়ন ডলার (কমেছে ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার)
সম্পদের উৎস: রিয়েল এস্টেট
নাগরিকত্ব: ফিলিপাইন
ম্যানিলা ভিত্তিক প্রপার্টি ডেভেলপার ‘ভিস্তা ল্যান্ড’-এর চেয়ারম্যান ভিলার নভেম্বরে মাত্র দুই দিনে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ হারিয়েছেন। কোম্পানিটি তাদের অন্যতম একটি প্রধান সম্পত্তির মূল্যায়ন ৯৯ শতাংশ কমিয়ে ফেলার ঘোষণা দেওয়ার পর এই বিপর্যয় ঘটে। ভিস্তা ল্যান্ডের শেয়ারের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে।