কসমেটিকস তৈরির জন্য শিকার হচ্ছে গভীর জলের হাঙর, বিলুপ্তি ঠেকাতে প্রয়োজন আইন
কসমেটিকস তৈরির জন্য শিকার হচ্ছে গভীর জলের হাঙর, বিলুপ্তি ঠেকাতে প্রয়োজন আইন
হাঙর থেকে ১ টন স্কোয়ালিন সংগ্রহ করতে প্রায় তিন হাজার হাঙর প্রয়োজন হয়। ২০১২ সালে বৈশ্বিক চাহিদা ছিল প্রায় দুই হাজার টন।
উজ্জ্বল সবুজ চোখ আর সরু দেহের কারণে গালপার হাঙর দেখতে বেশ অদ্ভুত, প্রায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো দেখায়। লাখ লাখ বছর ধরে টিকে থাকা এই হাঙরগুলো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সমুদ্রের ২০০ থেকে দেড় হাজার মিটার (৬৫০ থেকে ৪,৯০০ ফুট) গভীরে বাস করে। তবে এসব হাঙর সম্পর্কে এখনো অনেক কিছুই অজানা।
কিন্তু এখন তারা এক গভীর সংকটে পড়েছে। গালপার হাঙরের তিন-চতুর্থাংশ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে, কারণ তাদের লিভারের তেল সংগ্রহের জন্য তাদের ব্যাপক হারে ধরা হয়। এ প্রজাতির লিভারে স্কোয়ালিন নামের এক ধরনের রাসায়নিক যৌগের পরিমাণ বেশি থাকে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ময়েশ্চারাইজিং গুণের সমৃদ্ধ। আর এ যৌগ প্রসাধনী শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক প্রাণী কল্যাণ তহবিল (আইএফএডব্লিউ) জানিয়েছে, মেকআপ, আফটারশেভ, সানস্ক্রিন, এমনকি নিকোটিন প্যাচ ও অর্শের চিকিৎসায় ব্যবহৃত নানা ধরনের পণ্যে হাঙরের লিভারের তেল পাওয়া গেছে।
নতুন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা গালপার হাঙরের জন্য কিছু আশা জাগাতে পারে। ২৪ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাজার হাজার বিজ্ঞানী, প্রাণী সংরক্ষণ কর্মী, আইনজীবী এবং বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ উজবেকিস্তানের সমরকন্দে মিলিত হচ্ছেন বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের বিপন্ন প্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংক্রান্ত কনভেনশনের (সিআইটিইএস) ২০তম পার্টিসিপ্যান্টস সম্মেলনে।
বৃহস্পতিবার আলোচ্য বিষয় হিসেবে রয়েছে, সব গালপার হাঙরকে সিআইটিইএস-এর অ্যাপেন্ডিক্স-২-এ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব। এসব প্রস্তাব আন্তর্জাতিক সীমান্তে তাদের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে এবং পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করবে।
এর গভীরতা
এখন পর্যন্ত বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গভীর সাগরের প্রাণীদের দিকে খুব কম মনোযোগ দিয়েছে। এই হাঙর প্রজাতির প্রাণীগুলো ২ মিটার (৭ ফুট) পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। যদিও সিআইটিইএস-এর অ্যাপেন্ডিক্স-২-এ ১৪৫টির বেশি হাঙর ও রে প্রজাতি অন্তর্ভুক্ত আছে, তবে এর মধ্যে কোনোটি গভীর জলের প্রজাতি নয়। যার কারণে গভীর সাগরের প্রাণীদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থায় একটি বড় ফাঁক রয়ে গেছে।
কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতি এবং তীরবর্তী জলে মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গভীর জলে মাছ ধরার প্রবণতা বাড়ছে। এর ফলে এসব গভীর জলের প্রজাতি, যেমন গালপার হাঙর, দিন দিন আরও বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

লিভারে বেশি পরিমাণ স্কোয়ালিন থাকায় এ প্রজাতির হাঙর বেশি ধরা হয়। ছবি: আইএফএডাব্লিউ
২০২৪ সালে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় ৫২১ প্রজাতির গভীর জলের হাঙর ও রে-এর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ গভীর জলের হাঙরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশকে লিভারের তেলের পণ্য তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
গালপার হাঙর বিশেষভাবে মূল্যবান, কারণ তাদের লিভারের তেলে ৭০ শতাংশের বেশি স্কোয়ালিন থাকে। এ পরিমাণ অন্যান্য হাঙর প্রজাতির তুলনায় সর্বোচ্চ। এর ফলে কিছু অঞ্চলে গালপার হাঙরের সংখ্যা ৮০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে, যা তাদের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর সংকেত।
আইএফএডব্লিউ-এর নীতি বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক ম্যাট কলিস ব্যাখ্যা করে বলেন, গালপার হাঙরের সংখ্যা গত ২০–৩০ বছরে বেশ কমছে। তিনি বলেন, এর প্রধান কারণ দুইটি। সেগুলো হলো―গালপার হাঙরের লিভারের তেলের মূল্য বোঝার ফলে এটি বিশেষভাবে শিকারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে এবং মাছ ধরার প্রযুক্তির উন্নতি, যা আগের তুলনায় গভীর জলের প্রজাতি ধরাকে সহজ করে তুলেছে।
এত বড় হ্রাস গালপার হাঙরের জন্য প্রলয়ংকরি হতে পারে, কারণ এরা জীবনের শেষ দিকে পরিপক্ব হয় এবং প্রজনন ক্ষমতা ধীর। একবার তাদের সংখ্যা কমে গেলে, পুনরুদ্ধারে বছরখানিক সময় লাগতে পারে। এক বিজ্ঞানীর অনুমান অনুযায়ী, ডাম্ব গালপার হাঙর—যাকে দেখলে উদাসীন মনে হয়—অস্ট্রেলিয়ায় বেশি শিকার হয়েছে এবং তাদের মূল জনসংখ্যার মাত্র ২৫ শতাংশ পুনরুদ্ধারে লাগবে ৮৬ বছর।
কলিস বলেন, “এরা অন্যান্য মাছের তুলনায় স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো প্রজনন করে। এর ফলে তারা মাছ ধরার চাপের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল।”
মাল্টিমিলিয়ন ডলারের শিল্প
কিন্তু গভীর জলের হাঙররা মাল্টিমিলিয়ন ডলারের শিল্পের চাপে পড়েছে। মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ জানায়, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক স্কোয়ালিন বাজারের মূল্য প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ স্কোয়ালিন উদ্ভিদ থেকে আসে যার প্রধান উৎস জলপাইয়ের তেল। তবে হাঙর থেকে ১ টন স্কোয়ালিন সংগ্রহ করতে প্রায় তিন হাজার হাঙর প্রয়োজন হয়।
বার্ষিক হাঙরের লিভারের তেলের বাণিজ্য সম্পর্কে সীমিত তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১২ সালে বৈশ্বিক চাহিদা ছিল প্রায় দুই হাজার টন।
প্রসাধনী ও পার্সোনাল কেয়ারের শিল্প
স্কোয়ালিনের সবচেয়ে বড় ভোক্তা হলো প্রসাধনী ও পার্সোনাল কেয়ার শিল্প, যার আয় শেয়ারের ৭০ শতাংশের বেশি। কিছু কোম্পানি, যেমন ল’রিয়েল ও ইউনিলিভার (ডাভ, ভ্যাসলিনসহ অন্যান্য বিউটি ব্র্যান্ডের মালক) ২০০৮ সাল থেকেই তাদের পণ্য থেকে হাঙরের লিভারের তেল ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং উদ্ভিদভিত্তিক বিকল্প ব্যবহার শুরু করে।
তবে অন্যরা এখনও হাঙরের স্কোয়ালিন ব্যবহার করছে। ফরাসি সামুদ্রিক সংরক্ষণ সংস্থা ব্লুময়ের ২০১৫ সালের একটি বিশ্বব্যাপী গবেষণা অনুযায়ী, ৭২টি ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম পরীক্ষা করা হয়েছিল, যার মধ্যে ২০ শতাংশেই হাঙরের স্কোয়ালিন পাওয়া গেছে, বিশেষ করে এশিয়ার ব্র্যান্ডে এটি বেশি দেখা গেছে।

জালে আটকে পড়া গালপার হাঙর। ছবি: আইএফএডাব্লিউ
বিউটি ব্র্যান্ড বায়োসেন্স তাদের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আখ থেকে প্রাপ্ত স্কোয়ালিন ব্যবহার করছে। ব্র্যান্ডটির একজন মুখপাত্র সিএনএন-কে ইমেইলে জানিয়েছেন, বর্তমানে বায়ো-ইঞ্জিনিয়াররা হাঙরের লিভারের মতো উদ্ভিদভিত্তিক স্কোয়ালিন উৎপাদন করতে সক্ষম।
তারা বলেন, “আমাদের উদ্ভাবনী পণ্যগুলো দেখায় যে টেকসই বিকল্পগুলো শুধু বিদ্যমান নয়, বরং এগুলো আরও ভালো ফলাফল দিতে পারে।”
কলিস বলেন, যদিও ভোক্তারা যাতে সচেতনভাবে পণ্য নির্বাচন করতে পারেন, সেজন্য ব্র্যান্ডগুলোর উপর চাপ রয়েছে হাঙরের লিভারের তেল ব্যবহার বন্ধ করার এবং লেবেলিংয়ে স্বচ্ছতা বাড়ানোর। আর গালপার হাঙর রক্ষার ক্ষেত্রে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।
তিনি বলেন, “সিআইটিইএস হল এমন কিছু আন্তর্জাতিক চুক্তির মধ্যে একটি, যার সঙ্গে বাস্তবায়ন ও অনুগমন ব্যবস্থা যুক্ত রয়েছে। যদি কোনো দেশ টেকসই কিনা তা মূল্যায়ন না করেই যদি বড় পরিমাণে বাণিজ্য চালিয়ে যায় বা যদি বিধিসম্মতভাবে প্রজাতি সংগ্রহ না করে, তবে এর ফলে তাদের বাণিজ্য স্থগিত হতে পারে। যারা এই প্রজাতিগুলোর বাণিজ্য চালিয়ে যেতে চায়, তাদের জন্য ফিশারিজ ব্যবস্থাপনা ঠিক করা সত্যিকারের প্রণোদনা হতে পারে।”
বায়োসেন্স জানিয়েছে, “প্রসাধনী উপাদানের জন্য লক্ষ্যবস্তু হওয়া প্রজাতিগুলোর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা সমুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।” তারা আরও জানায়, সিআইটিইএস-এর প্রস্তাব প্রসাধনী শিল্পে প্রাণীজ উপাদান থেকে টেকসই বিকল্পে স্থানান্তর দ্রুততর করতে সাহায্য করবে।
গত দুই দশকে গালপার হাঙরের সংখ্যা হ্রাস এবং তাদের অ্যাপেন্ডিক্স-২-এ অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান নিয়মিতভাবে সিআইটিইএস বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে। সাম্প্রতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই তালিকাভুক্তি প্রয়োজনের চেয়ে দেরিতে করা হয়েছে।
প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এখনই জরুরি, যাতে গালপার হাঙরের সংখ্যা আরও কমে না যায় এবং ভবিষ্যতে তাদের অ্যাপেন্ডিক্স-১-এ অন্তর্ভুক্ত করতে না হয়, যা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে পারে।
যেমন মালদ্বীপ ২১ বছরে এর সংখ্যা ৯৭ শতাংশ কমে যাওয়ার পর ২০১০ সালে গালপার হাঙর শিকার নিষিদ্ধ করেছিল। সম্প্রতি তারা গালপার হাঙর মাছধরার নিয়মাবলি পুনরায় অনুমোদন করেছে। কলিস বলেন, এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি বাণিজ্য সীমিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আশা করছেন যে এই সপ্তাহের সম্মেলনে দলগুলো শেষ পর্যন্ত এই আহ্বানকে গুরুত্ব দেবে, যাতে ‘গালপার হাঙর’ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। তিনি বলেন, “এ হাঙর অন্যান্য মাছের মতো নয়, তাদের একই গতিতে পুনরুদ্ধার করা যায় না এবং একই গতিতে তাদের প্রজননও হয় না। এই মাত্রার শোষণ তারা আর সহ্য করতে পারবে না।”