জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল যে হাতিকে—‘মার্ডারাস মেরি’-র মর্মান্তিক কাহিনি

স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শোজ’ সার্কাসের বিশাল এক এশীয় হাতি ছিল ম্যারি। ১৯১৬ সালে সার্কাসের এক জমকালো শোভাযাত্রায় মাহুতকে পিষে হত্যার অভিযোগে তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।

26 DEC WEB
ছবি: ইন ডিফেন্স অফ অ্যানিমেলস

ইতিহাসের পাতায় কত অদ্ভুত আর করুণ ঘটনাই তো জমা থাকে। কিন্তু ‘ম্যারি’র গল্পটা বোধ হয় সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়।

সালটা ১৯১৬। যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির ছোট্ট এক শহর এরউইন। ‘স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শোজ’ সার্কাসের বিশাল এক এশীয় হাতি এই ম্যারি। পাঁচ টন ওজনের এই প্রাণীটিকেই প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল সেদিন।

ম্যারির ‘অপরাধ’? রেড এলড্রিজ নামের এক অনভিজ্ঞ মাহুতকে পিষে মেরে ফেলা। এই ঘটনা তখন পুরো আমেরিকাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে পশুদের প্রতি মানুষের আচরণ, নিষ্ঠুরতা এবং কোনো পশুর কাজের জন্য তাকে মানুষের মতোই ‘শাস্তি’ দেওয়া কতটা যৌক্তিক—সেসব প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসে ম্যারির এই করুণ পরিণতি।

হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও আবেগপ্রবণ প্রাণী। বহু শতাব্দী ধরে তারা মানুষের সঙ্গী। কখনো বন্ধু হিসেবে, কখনো বা কঠোর পরিশ্রমী কর্মী কিংবা সার্কাসের বিনোদনকারী হিসেবে তারা মানুষের সঙ্গেই আছে। তবুও ম্যারির গল্প আমাদের ভাবতে বাধ্য করে; আমরা আসলে তাদের কতটা বুঝি?

সেবার ওয়াল্টার ‘রেড’ এলড্রিজ নামের এক ভবঘুরে হোটেলকর্মীকে নিয়োগ দেওয়া হয় হাতির মাহুত হিসেবে। হাতির দেখভাল বা নিয়ন্ত্রণের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা প্রশিক্ষণ—কোনোটাই তার ছিল না। 

পরদিন টেনেসির কিংসপোর্ট শহরে সার্কাসের জমকালো শোভাযাত্রা চলছে। ম্যারিকে নিয়ে হাঁটছিলেন নতুন মাহুত এলড্রিজ। শোভাযাত্রার মাঝেই হাতে থাকা তীক্ষ্ণ অঙ্কুশ দিয়ে ম্যারিকে বারবার খোঁচাতে থাকেন এলড্রিজ । হাতিকে বশে রাখতে সাধারণত মাহুতরা এই যন্ত্র ব্যবহার করেন।

যন্ত্রণায় কিংবা বিরক্ত হয়েই হয়তো ম্যারি হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে এলড্রিজকে শূন্যে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলে সে। এরপর নিজের বিশাল পা দিয়ে পিষে দেয় তার মাথা।

চারদিকে শুরু হয়ে যায় হুলুস্থুল কাণ্ড। ম্যারিকে থামানোর জন্য এক ব্যক্তি নিজের পিস্তলের সব কটি গুলি ছুড়ে দেন তার দিকে। কিন্তু হাতির চামড়া এতই পুরু যে, সেই গুলি ম্যারির শরীরের ভেতরে ঢুকতেই পারেনি।

চোখের সামনে এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখে শিউরে ওঠে উপস্থিত জনতা। আতঙ্ক ও রোষে উত্তপ্ত জনতা চিৎকার করতে থাকে—’মেরে ফেলো হাতিটাকে!’ খবরের কাগজগুলোও ম্যারিকে আখ্যা দিল ‘মার্ডারাস ম্যারি’ হিসেবে।

ওদিকে সার্কাসের মালিকেরা পড়লেন মহাবিপদে। জনরোষের মুখে ব্যবসা যদি লাটে ওঠে! তাই জনতাকে শান্ত করতে তড়িঘড়ি এক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। ঘোষণা দেওয়া হলো—জনসমক্ষেই ম্যারিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

ম্যারির বয়স তখন মাত্র ২২ বছর। আড়াই হাজার উৎসুক মানুষের সামনে বিশাল এক রেলওয়ে ক্রেনে ঝুলিয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো তাকে। উদ্দেশ্য ছিল একে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করা। কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে সেদিন অনেকেই শিউরে উঠেছিলেন, প্রশ্ন করেছিলেন—মানুষ হিসেবে আমরা কতটা নিচে নামতে পারি?

এরউইন শহরের প্রায়শ্চিত্ত

টেনেসির যে এরউইন শহরে এই ঘটনা ঘটেছিল, ইতিহাসের পাতায় শহরটি একরকম কুখ্যাত হয়েই ছিল। তবে সেই কলঙ্ক মুছতে শহরবাসী এখন সচেষ্ট। ঘটনার ১০০ বছর পর, ২০১৬ সালে ম্যারির স্মরণে সেখানে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপী বিশেষ আয়োজন। হাতিদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। 

সেই প্রথম বছর স্থানীয় শিল্পীরা ফাইবারগ্লাস দিয়ে আটটি হাতির ভাস্কর্য তৈরি করেন। সেগুলো নিলামে বিক্রি করে প্রায় ৯ হাজার ডলার সংগ্রহ করা হয়। এই পুরো অর্থ তুলে দেওয়া হয় টিনেসির ‘দ্য এলিফ্যান্ট স্যাংচুয়ারি’র হাতে। আরউইন থেকে ছয় ঘণ্টার পথের দূরত্বে থাকা এই অভয়ারণ্যটি চিড়িয়াখানা বা সার্কাস থেকে অবসরে যাওয়া হাতিদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গত তিন দশক ধরে কাজ করছে।

সেই থেকে এ রউইনের বাসিন্দারা নিয়মিত হাতিদের সম্মান জানাতে এবং তাদের সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়াতে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছেন। শহরের দেয়ালে দেয়ালে এখন হাতিদের ছবি, চলছে সচেতনতামূলক কার্যক্রম। প্রাণীর প্রতিও যে মর্যাদা ও মানবিক আচরণ করা উচিত—ম্যারির করুণ মৃত্যু মানুষকে দেরিতে হলেও সেই শিক্ষা দিয়ে গেছে।

ম্যারির এই করুণ কাহিনি মানুষ ও হাতির দীর্ঘ সম্পর্কের ইতিহাসের একটি ছোট অধ্যায় মাত্র। যুগে যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে হাতিকে দেখা হয়েছে শক্তি, প্রজ্ঞা আর আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হিসেবে। বিশেষ করে এশিয়ায় ধর্মীয় উৎসব থেকে শুরু করে ভারী কাজ—সবখানেই হাতির কদর বহুদিনের।

হাতি যে কতটা বুদ্ধিমান আর সামাজিক জীব, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। গবেষণায় দেখা গেছে, এদের আত্মবোধ প্রবল। মানুষের মতোই এরা পরিবারের সঙ্গে গভীর বন্ধন গড়ে তোলে, স্বজন হারালে কষ্ট পায়, এমনকি অন্যের দুঃখেও ব্যথিত হয়।

কিন্তু বিনোদনের খোরাক জোগাতে গিয়ে মানুষ প্রায়ই ভুলে যায় এদের অনুভূতির কথা। সার্কাসের জৌলুশ আর করতালির আড়ালে চাপা পড়ে থাকে এদের ওপর চলা নিদারুণ অত্যাচার। বিশাল দেহ আর প্রখর বুদ্ধিমত্তার কারণে এদের বন্দি করে বশে রাখা বেশ কঠিন। তাই ব্যবহার করা হয় শিকল আর অঙ্কুশের মতো নিষ্ঠুর সব হাতিয়ার। ম্যারির ক্ষেত্রেও সেই নিষ্ঠুরতারই তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।

বিশ্বজুড়ে হাতিদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে । অনেক বিখ্যাত সার্কাস দল এখন আর তাদের শো-তে হাতি ব্যবহার করে না। টেনেসির অভয়ারণ্যের মতোই বিশ্বের নানা প্রান্তে গড়ে উঠেছে হাতিদের নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে অবসরপ্রাপ্ত হাতিরা পায় স্বাভাবিক ও মুক্ত জীবন।

তবে ম্যারির আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। ম্যারি শিখিয়ে দিয়ে গেছে—পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীরই ভালোবাসা আর সম্মান পাওয়ার অধিকার আছে। তার গল্প আজ পশু অধিকার আন্দোলনের অন্যতম এক অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে আছে মানুষের বিবেকে।