‘পানি নেই তো জীবনও নেই’; হারিয়ে যাওয়ার পথে ইরাকের টাইগ্রিস নদী

যে নদীর তীরে জন্মেছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতা, সেই টাইগ্রিস আজ ‘মরণদশায়’। অনেক জায়গায় নদীটি এখন পায়ে হেঁটেই পেরোনো যায়। আর এই নদী বিপন্ন হওয়ার সঙ্গেই অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে ইরাকের হাজার বছরের পুরোনো এক ধর্মীয় সম্প্রদায়।

ezgif-43319124ac79a209
ছবি: এমিলি গার্থওয়াইট

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা শেখ নিধাম ক্লেইদি আল-সাবাহি। ৬৮ বছর বয়সী এই নেতার পরনে সাধারণ বাদামি আলখাল্লা, লম্বা পাকা দাড়ি নেমে এসেছে বুক অবধি। মাথায় সাদা টুপি, তার নিচে লম্বা চুল। ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে এই চুল কখনোই কাটেন না তিনি। 

ধর্মীয় নিয়ম মেনে তিনি কেবল প্রবহমান নদীর পানি ব্যবহার করেন। এমনকি তৃষ্ণা মেটাতেও তার ভরসা নদীর স্রোতের পানি। বিশেষ করে, দজলা (টাইগ্রিস) নদীর পানি। তার দাবি, নদীর পানি পান করে তিনি কখনোই অসুস্থ হননি। তার বিশ্বাস, পানি যত দিন বইবে, তত দিন তা পরিষ্কার।

কিন্তু কঠিন সত্য হলো, এই নদীর প্রবাহ হয়তো আর বেশি দিন থাকবে না। ইরাকের বিখ্যাত টাইগ্রিস নদী এখন মারাত্মক দূষণের শিকার, রয়েছে শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতেও। এখনই নদীটি বাঁচাতে জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়া হলে টাইগ্রিস তীরে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা আমূল বদলে যাবে। হুমকির মুখে পড়বে তাদের অস্তিত্ব।

‘পানি নেই, মানে জীবনও নেই’, বলছিলেন মানদিয়ান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা শেখ নিধাম। দক্ষিণ ইরাকের আমারা শহরে টাইগ্রিস নদীর তীরেই তার বাস। মাত্র এক মাস বয়স থেকে নিয়মিত এই নদীর পানিতে ডুব দিয়ে স্নান সেরে আসছেন তিনি।

মানদিয়ানরা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এক ধর্মীয় গোষ্ঠী। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ ইরাক, বিশেষ করে মায়সান প্রদেশই তাদের আবাসভূমি। এই প্রদেশের রাজধানী আমারা শহরটি গড়ে উঠেছে টাইগ্রিস নদীকে ঘিরেই।

ছবি: এএফপি

এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসের মূল কেন্দ্রবিন্দু পানি। জীবনের প্রতিটি বড় উপলক্ষেই পানিতে নেমে পবিত্র হওয়ার রীতি মেনে চলেন তারা। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় পানিতে। এমনকি মৃত্যুর আগে শেষনিশ্বাস ত্যাগের আগমুহূর্তেও মানদিয়ানদের নদীতে নিয়ে শেষবারের মতো পবিত্র করার নিয়ম রয়েছে।

শেখ নিধাম বলেন, ‘আমাদের ধর্মে পানির গুরুত্ব বাতাসের মতোই। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবীতে প্রথম মানুষ ছিলেন আদম। আদমের আগেও ছিল পানি। আর আদমকে সৃষ্টির অন্যতম উপাদানও ছিল এই পানি।’

প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার প্রাণ ছিল যে দুটি নদী, টাইগ্রিস তার একটি। তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়ে ইরাকের প্রধান দুই শহর মসুল ও বাগদাদের বুক চিরে বয়ে গেছে টাইগ্রিস। এরপর ফোরাত নদীর সঙ্গে মিশে ‘শাত-ইল-আরব’ নাম নিয়ে শেষমেশ পতিত হয়েছে পারস্য উপসাগরে।

এই নদীর তীরেই প্রথম বড় পরিসরে কৃষিকাজ শুরু হয়, লেখা হয় প্রথম শব্দ, আবিষ্কৃত হয় চাকা। বর্তমানে সেচ, যাতায়াত, শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে এই অববাহিকার প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের খাওয়ার পানির জোগান দিচ্ছে টাইগ্রিস।

নদী রক্ষায় কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘হুমাত ডিজলা’র প্রতিষ্ঠাতা সালমান খাইরাল্লা বলেন, ‘ইরাকিদের পুরো জীবনই পানির ওপর নির্ভরশীল। যত সভ্যতা বা গল্পের কথা আমরা শুনি, তার সবই এই দুই নদীকে ঘিরে। শুধু পান করা, সেচ দেওয়া বা ধোয়া–মোছার পানি নয়; টাইগ্রিস এখানকার মানুষের কাছে আধ্যাত্মিকতার চেয়েও বেশি কিছু।’

তবে কয়েক দশক ধরেই রুগ্‌ণ দশা টাইগ্রিসের। ইরাকে একসময় অত্যাধুনিক পানি ব্যবস্থাপনা ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’-এর সময় যুক্তরাষ্ট্র এর ওপর হামলা চালায়। ধ্বংস হয়ে যায় শোধনাগারগুলো, ফলে বর্জ্য সরাসরি মিশতে থাকে নদীর পানিতে। এরপর বছরের পর বছর নিষেধাজ্ঞা ও সংঘাতের কারণে সেই কাঠামো আর পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। 

বর্তমানে ইরাকের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে শহরের মাত্র ৩০ শতাংশ বাড়ি বর্জ্য শোধনাগারের সঙ্গে যুক্ত। গ্রামাঞ্চলে এই হার মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

কেবল গৃহস্থালি বর্জ্যই নয়; কৃষিজমির রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, তেলক্ষেত্রসহ বিভিন্ন কারখানার শিল্পবর্জ্য এবং চিকিৎসাবর্জ্য—সবই গিয়ে মিশছে নদীতে। ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাগদাদের বহু জায়গায় পানির মান ‘খারাপ’ বা ‘খুবই খারাপ’। 

এর ভয়াবহ প্রভাবও দেখা গেছে। ২০১৮ সালে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বসরায় দূষিত পানি পান করে অন্তত ১ লাখ ১৮ হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

কেবল দূষণ নয়, টাইগ্রিসের পানির প্রবাহও আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। গত ৩০ বছরে টাইগ্রিসের ওপর একাধিক বড় বাঁধ নির্মাণ করেছে তুরস্ক। এতে বাগদাদে পানির প্রবাহ কমেছে ৩৩ শতাংশ। ইরানও বাঁধ নির্মাণ করে টাইগ্রিসের উপনদীগুলোর গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়েছে।

ইরাকের ভেতরেও পানির অতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। দেশটির মোট ভূ-উপরিস্থ পানির অন্তত ৮৫ শতাংশই ব্যয় হয় কৃষিকাজে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। ইরাকে বৃষ্টিপাত কমেছে ৩০ শতাংশ। গত এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে দেশটি। 

আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ মিঠাপানির চাহিদা জোগানের চেয়ে বেশি হবে। এ বছর গ্রীষ্মে দজলার পানি এতটাই কমে গিয়েছিল যে মানুষ হেঁটে সহজেই নদী পার হতে পেরেছে।

পরিবেশকর্মী সালমান খাইরাল্লা মনে করেন, উজানে বাঁধ নির্মাণ ও অব্যবস্থাপনাই এর মূল কারণ। নদীর প্রবাহ কমলে দূষণ বেড়ে যায়। তার কথায়, ‘পানির গুণমান নির্ভর করে এর পরিমাণের ওপর।’

বাঁধ থেকে আরও বেশি পানি ছাড়ার জন্য উত্তরের প্রতিবেশী তুরস্ককে বারবার চাপ দিয়ে আসছে ইরাক সরকার। তবে আলোচনার সময় তুর্কি কর্মকর্তারা উল্টো ইরাকের ভেতরে পানির অপচয়ের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন।

ছবি: এএফপি

টাইগ্রিসের সংকট কাটাতে গত নভেম্বরে একটি সমঝোতায় পৌঁছায় বাগদাদ ও আঙ্কারা। এর আওতায় দূষণ রোধ, আধুনিক সেচপ্রযুক্তি, কৃষিজমি পুনরুদ্ধার ও পানির সুষম বণ্টন নিয়ে কাজ করা হবে। একে বলা হচ্ছে ‘তেলের বিনিময়ে পানি’ চুক্তি। কারণ, তুরস্কের কোম্পানিগুলো ইরাকে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করবে আর এর মূল্য পরিশোধ করা হবে তেল বিক্রির অর্থ দিয়ে। ইরাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে ‘অভিনব’ এক চুক্তি বলে অভিহিত করেছে।

তবে এই চুক্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশকর্মীদের মধ্যে তীব্র সমালোচনাও আছে। সাধারণ মানুষও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁদের অভিযোগ, চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। এতে মনে হচ্ছে, ইরাকের পানিসম্পদের নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের হাতেই তুলে দেওয়া হলো। তা ছাড়া এই চুক্তি আইনত মানার কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।

ইরাকের সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী মহসিন আল-শামারি তো সরাসরি বলেই দিলেন, ‘আসলে এখন কোনো চুক্তিই নেই। আমার মনে হয়, এটা নির্বাচনী প্রচারণা ছাড়া আর কিছু না।’ ইরাকের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র ৯ দিন আগে ওই চুক্তি সই হয়েছিল।

এ বিষয়ে ইরাকের পানি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং সরকারের মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে পানি ছাড়া দক্ষিণ ইরাকে মানদিয়ান সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত শেখ নিধাম। অস্তিত্ব রক্ষায় অনেকেই ইতিমধ্যে দেশ ছেড়েছেন অথবা উজানের দিকে স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছেন।

ধারণা করা হয়, বিশ্বে বর্তমানে মানদিয়ান সম্প্রদায়ের ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষ রয়েছেন। এর মধ্যে ইরাকে টিকে আছেন ১০ হাজারের কম। টাইগ্রিস নদী মরে গেলে ইরাক থেকে প্রাচীন এই জনগোষ্ঠীও হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে।