যে কারণে গান গাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী
মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে হৃদপিণ্ড—গান গাওয়ার গুণের শেষ নেই। বিশেষ করে দলবেঁধে গান গাইলে উপকার মেলে আরও বেশি।
যে কারণে গান গাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী
মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে হৃদপিণ্ড—গান গাওয়ার গুণের শেষ নেই। বিশেষ করে দলবেঁধে গান গাইলে উপকার মেলে আরও বেশি।
মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে হৃদপিণ্ড—গান গাওয়ার গুণের শেষ নেই। বিশেষ করে দলবেঁধে গান গাইলে উপকার মেলে আরও বেশি। এতে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়। শরীর রোগ প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়। এমনকি ব্যথা কমাতেও এটি সাহায্য করে।
ক্যামব্রিজ ইনস্টিটিউট ফর মিউজিক থেরাপি রিসার্চের গবেষক অ্যালেক্স স্ট্রিট বলেন, “গান গাওয়া একটি শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কাজ।”
মনোবিজ্ঞানীরাও বিষয়টি নিয়ে অবাক। দেখা গেছে, একদম অপরিচিত মানুষও যদি এক ঘণ্টা একসঙ্গে গান গান, তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়।
গান গাইলে ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্র ভালো থাকে। এর আরও অনেক শারীরিক সুফল আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গান মানুষের হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। শুধু গান শোনার চেয়ে দলবেঁধে গান গাইলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
জীববিজ্ঞানের ভাষায় এর ব্যাখ্যাও আছে। গান গাওয়ার সময় আমাদের গলার পেছনের ‘ভেগাস নার্ভ’ সক্রিয় হয়। এটি সরাসরি স্বরযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া গান গাওয়ার সময় আমরা গভীরভাবে শ্বাস ছাড়ি। এতে ‘এনডরফিন’ হরমোন নিসৃত হয়। এই হরমোন ব্যথা কমায় এবং মন ভালো রাখে।
গান গাওয়ার সময় মস্তিষ্কের ভাষা, নড়াচড়া ও আবেগের অংশগুলো একসঙ্গে কাজ করে। শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিতে হয় বলে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কমে। অ্যালেক্স স্ট্রিট বলেন, “গান গাওয়ার পর মানুষের মুখের অভিব্যক্তি ও শরীরী ভাষাতেই প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।”
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আদিম মানুষ কথা বলা শেখার আগেই গান গাইত। তারা প্রকৃতির শব্দ নকল করত বা মনের ভাব প্রকাশ করত। তাই জন্মের পর থেকেই গান বা সুরের প্রতি আমাদের মস্তিষ্ক ও শরীর ইতিবাচক সাড়া দেয়। অ্যালেক্স স্ট্রিট বলেন, “শিশুদের ঘুম পাড়ানি গান থেকে শুরু করে শেষকৃত্য—সবখানেই গানের উপস্থিতি। আমরা নামতা শিখি ছন্দে ছন্দে, বর্ণমালা শিখি সুরের মাধ্যমে।”
ব্যায়ামের বিকল্প
একা গাওয়ার চেয়ে দলবেঁধে বা কোরাস গাওয়ায় মানসিক শান্তি বেশি মেলে। শিশুদের সহযোগিতা, ভাষার বিকাশ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে গান ব্যবহার করা হয়।
বিভিন্ন রোগের চিকিৎসাতেও গান এখন বড় ভূমিকা রাখছে। ক্যান্সার, স্ট্রোক, পারকিনসন্স বা ডিমেনশিয়া রোগীদের জন্য গানের দল তৈরি করা হচ্ছে। দেখা গেছে, গান গাওয়ার ফলে পারকিনসন্স রোগীরা কথা বলার জড়তা কাটাতে পারেন।

একাকী গান গাওয়ার চেয়ে অন্যদের সাথে গান গাওয়া বেশি উপকারী হতে পারে
সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্বাসতন্ত্রের ফিজিওথেরাপি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অ্যাডাম লুইস বলেন, “গান গাওয়া এক ধরনের শারীরিক কসরত। ব্যায়ামের মতোই এর উপকারিতা আছে।”
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গান গাওয়া হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের জন্য ট্রেডমিলে মাঝারি গতিতে হাঁটার সমান উপকারী।
দীর্ঘমেয়াদী রোগে স্বস্তি
যারা দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগছেন, তাদের জন্যও গান আশীর্বাদ। এটি রোগীকে মনে করিয়ে দেয় যে তারা কী করতে পারেন, শুধু অক্ষমতার দিকে নজর না দিয়ে। অ্যালেক্স স্ট্রিট বলেন, “গানের ঘরে সবাই সমান। সেখানে কেউ সেবাদানকারী বা রোগী নন, সবাই তখন একই সুরে গান গাইছেন।”
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের কিয়ার ফিলিপ শ্বাসকষ্টের রোগীদের নিয়ে কাজ করেন। তিনি জানান, গান গাইলে শ্বাস নেওয়ার ধরণ ঠিক হয়। লং কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের ওপর একটি পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। ছয় সপ্তাহ গান গাওয়ার পর তাদের শ্বাসকষ্ট কমেছে এবং জীবনযাত্রার মান বেড়েছে।

গান গাওয়া মস্তিষ্কের পাশাপাশি শ্বাসযন্ত্রের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।
তবে কিয়ার ফিলিপ সতর্কও করেছেন। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে গানের দলে না যাওয়াই ভালো। কারণ গান গাওয়ার সময় বাতাস ও ভাইরাসে ছড়াতে পারে। কোভিডের শুরুর দিকে গানের দল থেকে ভাইরাস ছড়ানোর ঘটনা ঘটেছিল।
মস্তিষ্ক মেরামতে গান
গানের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিক হলো এটি মস্তিষ্ককে সারিয়ে তুলতে পারে। আমেরিকার সাবেক কংগ্রেস সদস্য গ্যাব্রিয়েল গিফোর্ডস ২০১১ সালে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি হাঁটাচলা ও কথা বলা ভুলে গিয়েছিলেন। ছোটবেলার গানগুলো ব্যবহার করে থেরাপিস্টরা তাকে আবার কথা বলা শিখিয়েছেন।
স্ট্রোকের রোগীদের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বারবার গান গাওয়ার ফলে মস্তিষ্কের দুই অংশের মধ্যে নতুন সংযোগ তৈরি হয়। একে বলা হয় ‘নিউরোপ্লাস্টিসিটি’ বা মস্তিষ্কের নতুন করে বিন্যস্ত হওয়া। হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টেপ্পো সারকামোর মতে, বয়স্কদের স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতেও গান সাহায্য করতে পারে।
অ্যালেক্স স্ট্রিট মনে করেন, গান মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু তার শঙ্কা, মানুষ এখন একে অপরের সঙ্গে মেশার চেয়ে প্রযুক্তিতে বেশি সময় দিচ্ছে। ফলে গানের এই সুফল থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, “মস্তিষ্কের আঘাত সারাতে গানের ভূমিকা নিয়ে কেবল জানা শুরু হয়েছে। গান সবসময়ই মানুষকে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করেছে।”