screenshot_2025-11-14_at_9.49.24_am
ছবি: দি ইকোনমিস্ট

তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। একা থাকাটা একদিকে যেমন মুক্তির স্বাদ দেয়, তেমনই তীব্র একাকীত্বও নিয়ে আসে। অনেক সিঙ্গেল মানুষই মুখে বলেন যে তারা এভাবেই খুশি, বিশেষ করে নারীরা। কিন্তু বিভিন্ন দেশের জরিপ বলছে, ৬০-৭৩% মানুষই আসলে একটি সম্পর্কে থাকতে চান।
মানব ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে, জুটি বাঁধাটা কেবল সামাজিক প্রথা ছিল না, ছিল এক অপরিহার্য বাস্তবতা।তাই বিয়ে বা যেকোনো ধরনের সম্পর্কের প্রথাটি যে গতিতে পরিত্যক্ত হচ্ছে, তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। 

উন্নত বিশ্বজুড়ে ‘সিঙ্গেলহুড’ বা একা থাকার প্রবণতা যেন এক নতুন মহামারী। ২৫-৩৪ বছর বয়সী আমেরিকানদের মধ্যে, কোনো সঙ্গী বা পার্টনার ছাড়া বসবাসকারী পুরুষের সংখ্যা গত পাঁচ দশকে দ্বিগুণ হয়ে ৫০%-এ দাঁড়িয়েছে, আর নারীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৪১%। ২০১০ সাল থেকে, ৩০টি ধনী দেশের মধ্যে ২৬টিতেই একা বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দ্য ইকোনমিস্ট -এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের তুলনায় জুটি বাঁধার হার যদি একই থাকত, তবে আজ বিশ্বে কমপক্ষে ১০ কোটি কম সিঙ্গেল মানুষ থাকত। বিশ্বজুড়ে চলছে এক বিশাল ‘সম্পর্কের মন্দা’।

এই চিত্র দেখে একদল মনে করছেন, এটি সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত লক্ষণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমর্থক আন্দোলনের অনেকেই বিশ্বাস করেন, তরুণদের বিয়ে করে থিতু না হওয়ার এই ব্যর্থতা পশ্চিমা সভ্যতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার সামিল। অন্যরা আবার একে দেখছেন প্রশংসনীয় আত্মনির্ভরতার প্রতীক হিসেবে। ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগ তো সম্প্রতি বলেই দিয়েছে, আজকের আধুনিক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণীদের জন্য বয়ফ্রেন্ড থাকাটা কেবল অপ্রয়োজনীয়ই নয়, বরং রীতিমতো ‘লজ্জাজনক’।

আসলে, এই সিঙ্গেলহুডের উত্থানকে এককথায় ভালো বা খারাপ বলা চলে না। কর্মক্ষেত্রে নারীদের বাধাগুলো সরে যাওয়ায় তাদের পছন্দের পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাবলম্বী, তাই একা থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং এর জন্য সামাজিক কলঙ্কেরও ভয় কম। তারা যত বেশি আর্থিকভাবে স্বাধীন হচ্ছে, তত কম তারা একজন অযোগ্য বা নির্যাতনকারী সঙ্গীর সাথে জীবন কাটাতে রাজি হচ্ছে। 

তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। একা থাকাটা একদিকে যেমন মুক্তির স্বাদ দেয়, তেমনই তীব্র একাকীত্বও নিয়ে আসে। অনেক সিঙ্গেল মানুষই মুখে বলেন যে তারা এভাবেই খুশি, বিশেষ করে নারীরা। কিন্তু বিভিন্ন দেশের জরিপ বলছে, ৬০-৭৩% মানুষই আসলে একটি সম্পর্কে থাকতে চান। ২০১৯ সালের আমেরিকার এক জরিপে দেখা যায়, যদিও ৫০% সিঙ্গেল সক্রিয়ভাবে সঙ্গী খুঁজছিলেন না, তবে তাদের মধ্যে মাত্র ২৭% বলেছেন যে তারা সিঙ্গেল থাকাটা উপভোগ করছেন। বাকিরা হয়তো মনের মতো সঙ্গী খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছেন, অথবা বাজারে থাকা সঙ্গীরা তাদের পছন্দসই নয়।

সম্পর্কের বাজারে এই মন্দা কেন?

যদি এত মানুষ জুটি বাঁধতে চেয়েও না পারে, তবে সম্পর্কের ‘বাজারে’ নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো গড়মিল রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডেটিং অ্যাপগুলো অবাস্তব প্রত্যাশা (ইনস্টাগ্রামে অন্যের সম্পর্ক দেখে মনে হয় যেন স্বর্গের বাগান) এবং অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে স্বভাব তৈরি করেছে (বাম্বলের বেশিরভাগ নারীই নাকি ছয় ফুট লম্বা পুরুষ চান, যা ৮৫% সম্ভাব্য সঙ্গীকেই তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়)। আরেকটি বড় সমস্যা হলো তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেড়ে চলা রাজনৈতিক বিভেদ, যেখানে ছেলেরা ডানপন্থী এবং মেয়েরা বামপন্থী দিকে ঝুঁকছে।

অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে জীবন কাটানোয় সামাজিক দক্ষতার অভাব দেখা দিয়েছে। সব বয়সী আমেরিকানরাই এখন সামনাসামনি কম মেলামেশা করে, তবে তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতা ভয়াবহ। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে নারীদের মধ্যে বাইরে গেলে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয় এবং পুরুষদের মধ্যে কোনো ডেট ঠিকঠাক না হলে অপমানিত হওয়ার আতঙ্ক কাজ করে।

তবে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ হলো, একা থাকাটা সহজ হয়ে যাওয়ায় নারীদের প্রত্যাশার পারদও চড়েছে। অনেকের কাছেই, একজন মাঝারি মানের সঙ্গীর চেয়ে একা থাকাটাই এখন অনেক বেশি আকর্ষণীয়। নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি করে চান যে তাদের সঙ্গী সুশিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল হোক। বহু পুরুষ এই ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে, কারণ তারা শিক্ষাগতভাবে নারীদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে এবং চাকরির বাজারে হিমশিম খাচ্ছে।

এই সমস্যাগুলোর কিছু হয়তো নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। একটি স্পষ্ট উপায় হলো, পুরুষদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া, ঘরের কাজে আরও বেশি সাহায্য করা এবং নিজেদেরকে আরও আকর্ষণীয় সঙ্গী হিসেবে গড়ে তোলা।

কিন্তু আলোকিত দেশ হিসেবে পরিচিত নর্ডিক দেশগুলোতেও সিঙ্গেলহুডের এই স্রোত কমার কোনো লক্ষণই নেই। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক একাই থাকেন। এই পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে জন্মহারের নাটকীয় পতনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। আর যেহেতু তরুণ, অবিবাহিত পুরুষরা বেশি সহিংস অপরাধ করে, তাই কম জুটি বাঁধা একটি বিশ্ব আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

এমনও হতে পারে যে সম্পর্কের এই মন্দা আর কখনোই ঠিক হবে না। ভাবুন তো, ৭% তরুণ সিঙ্গেল বলছেন, তারা একটি এআই সঙ্গীর সাথে রোবোটিক প্রেম করতেও রাজি! আর এই ‘লাভবট’গুলো দিন দিন আরও উন্নত হবে। এআই ধৈর্যশীল, এআই দয়ালু; সে আপনাকে বাথরুম পরিষ্কার করতে বা আরও ভালো চাকরি খুঁজতে বলে না।

অনেকেরই হয়তো আশঙ্কা, কম দম্পতি এবং কম শিশুর একটি বিশ্ব আরও বিষণ্ণ এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তবে এই সম্ভাবনা নিয়ে শুধু আক্ষেপ করলেই তা এড়ানো যাবে না। আর মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর জোর খাটানো সরকারের কাজ নয়। আরও বেশি সিঙ্গেল মানুষের এক নতুন ভবিষ্যৎ দরজায় কড়া নাড়ছে। নির্মাণ সংস্থা থেকে শুরু করে কর বিভাগ পর্যন্ত, সবারই এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত।