21 DEC WEB
প্রতীকী ছবি: এআই

দেশের নাগরিকদের টাক সমস্যা সমাধানে এক নতুন অভিযানে নেমেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং। তিনি প্রস্তাব করেছেন, চুল পড়ার চিকিৎসার খরচ জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচির আওতায় আনা উচিত।

চলতি সপ্তাহে কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে প্রেসিডেন্ট লি এই প্রস্তাব দেন। তিনি যুক্তি দেখান, চুল পড়ার চিকিৎসাকে একসময় কেবল ‘কসমেটিক’ বা সৌন্দর্যবর্ধন হিসেবে দেখা হতো, কিন্তু এখন এটি মানুষের জন্য ‘টিকে থাকার লড়াই’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় স্বাস্থ্য বীমায় কোনো রোগের কারণে চুল পড়লে তার চিকিৎসার খরচ বহন করা হয়। তবে গত মঙ্গলবার এক বৈঠকে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী জং ইউন-কিয়ং জানান, বংশগত কারণে চুল পড়া বা টাকের সমস্যা জীবনের জন্য হুমকি নয় বলে এটি বীমার আওতাভুক্ত নয়। এর জবাবে প্রেসিডেন্ট লি প্রশ্ন রাখেন, ‘বংশগত রোগকে রোগ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হবে কি না, এটা কি কেবল সেই বিষয়?’

প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। একজন ব্যবহারকারী তাকে ‘ইতিহাসের সেরা প্রেসিডেন্ট’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন। তবে সবাই এতে উচ্ছ্বসিত নন। এমনকি যারা এই সুবিধা পাবেন, তাদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

সিউলের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী সং জি-হুন, যিনি চুল পড়ার ওষুধ সেবন করেন, বলেন, ‘এটি অনেকটা ভোট টানার কৌশলের মতো মনে হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘টাকা বাঁচানো শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু সত্যি বলতে বছরে এর খরচ ৩ লাখ উনের (২০০ ডলার) কম। তাই প্রশ্ন জাগে, আদৌ কি এর প্রয়োজন আছে?’

সৌন্দর্য সচেতনতা নাকি টিকে থাকার লড়াই?

দক্ষিণ কোরিয়া সৌন্দর্যের কড়াকড়ি মানদণ্ডের জন্য পরিচিত। সেখানে টাক মাথাকে সামাজিকভাবে হেয় বা ‘স্টিগমা’ হিসেবে দেখা হয়, যা তরুণদের জন্য বিশেষ উদ্বেগের কারণ। কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, গত বছর দেশটিতে চুল পড়ার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাওয়া ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশই ছিলেন ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী।

উত্তর চুংচেং প্রদেশের বাসিন্দা ৩৩ বছর বয়সী লি ওন-উ বলেন, ‘আমি আমার ইচ্ছেমতো চুলে স্টাইল করতে পারি না। তখন নিজেকে অপরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণহীন মনে হয়, যা আমার আত্মবিশ্বাস মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে।’

তবে তিনি এও মনে করেন, সরকারি ভর্তুকি পেলে তিনি কৃতজ্ঞ থাকবেন ঠিকই, কিন্তু জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা এমনিতেই আর্থিক ঘাটতিতে ধুঁকছে। এটি এমন কোনো পরিস্থিতি নয় যেখানে চাইলেই টাকা বিলানো যায়। তার মতে, টাক পড়া বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কোনো অসুস্থতা নয়। মানসিক কষ্ট থাকলেও বাস্তবতা বদলায় না।

দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা স্কিম গত বছর রেকর্ড ১১.৪ ট্রিলিয়ন উন (৭.৭ বিলিয়ন ডলার) ঘাটতির মুখে পড়েছে। বয়স্ক জনসংখ্যা বাড়ার কারণে এই চাপ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট লি অবশ্য বলেছেন, আর্থিক বোঝা কমাতে কর্তৃপক্ষ কভারেজের সীমা নির্ধারণ করতে পারে।

তবে সমালোচকরা বলছেন, সমাজের অসহায় মানুষের সহায়তায় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কোরিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বুধবার এক বিবৃতিতে বলেছে, সরকারি তহবিল চুল পড়ার আগে আরও গুরুতর রোগের চিকিৎসায় ব্যয় করা উচিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকে দেশটির উচ্চ আত্মহত্যার হার ও নারীদের প্রতি বৈষম্যের মতো বড় সমস্যাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
এক্সে (সাবেক টুইটার) একজন লিখেছেন, ‘যে দেশে স্যানিটারি প্যাড বা স্তন ক্যানসারের ওষুধ বীমার আওতায় আনার দাবিতে মানুষ হিমশিম খায়, সেখানে চুল পড়ার ওষুধ বীমার আওতায় আনার ঘোষণাটি একটি খারাপ কৌতুক বলে মনে হয়।’

অন্য একজন লিখেছেন, ‘যদি চুল পড়া সত্যিই সমাজে টিকে থাকার নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়ায়, তবে রাজনীতির উচিত সেই সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা।’

নেপথ্যে রাজনীতি?

২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় লির অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল এই টাকের চিকিৎসার বীমা সুবিধা। সেবার তিনি হেরে গেলেও চলতি বছর নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

সে সময় লি এবং তার দল চুল পড়ার সমস্যায় ভোগা মানুষের মতামত সংগ্রহ করেছিলেন। এমনকি তিনি চুল পড়া প্রতিরোধক একটি পণ্যের ভাইরাল প্যারোডি বিজ্ঞাপনেও অভিনয় করেছিলেন, যা কিছু ভোটারের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

তবে সমালোচকদের অভিযোগ, লি মূলত তরুণ পুরুষ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চটকদার কৌশল বা ‘গিমিক’ ব্যবহার করেছিলেন। কারণ ওই সময় নারীবাদবিরোধী মনোভাবের জোয়ারে তরুণদের একটি বড় অংশ লির রক্ষণশীল প্রতিপক্ষকে সমর্থন দিচ্ছিল।

২০২২ সালের নির্বাচনে লি হেরে যান। চলতি বছর তিনি ফের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তবে এবারের প্রচারণায় চুল পড়ার চিকিৎসার বিষয়টি আর ছিল না।

কোরিয়া ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ডন এস লি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হয়তো ২০২৬ সালের মাঝামাঝি অনুষ্ঠিতব্য স্থানীয় নির্বাচনের জন্য তার সমর্থক গোষ্ঠী বাড়াতে চাইছেন।’

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে লি দেশের তরুণদের ওপর বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন, যারা তীব্র প্রতিযোগিতা এবং হতাশাজনক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি। গত মঙ্গলবার তিনি স্থূলতার ওষুধকেও স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনার পরামর্শ দেন। তিনি যুক্তি দেন, তরুণরা মনে করছে বীমা সুবিধাগুলো তাদের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

তবে অধ্যাপক ডন এস লির মতে, প্রেসিডেন্ট লি শেষ পর্যন্ত চুল পড়ার চিকিৎসাকে বীমার আওতায় আনবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, ‘এটি তরুণ পুরুষ ভোটারদের লক্ষ্য করে একটি কৌশলগত বার্তা মাত্র, যার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চাইছেন— আমিও তোমাদের কথা ভাবছি।’