প্রতি মাসে গড়ে ৯টি বাঘ উদ্ধার; বিশ্বজুড়ে তীব্র হচ্ছে বাঘ পাচার সংকট
প্রতি মাসে গড়ে ৯টি বাঘ উদ্ধার; বিশ্বজুড়ে তীব্র হচ্ছে বাঘ পাচার সংকট
প্রতিবেদন বলছে, ২০০০-এর দশকে উদ্ধারকৃত ৯০ শতাংশই ছিল বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কিন্তু ২০২০ সালের পর এটি ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর পরিবর্তে জায়গা দখল করেছে আস্ত মৃত বা জীবিত বাঘ।
বিশ্বব্যাপী গত পাঁচ বছরে প্রতি মাসে গড়ে নয়টি করে বাঘ উদ্ধার করা হয়েছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশ্বের অন্যতম আইকনিক এ প্রজাতিটি পাচারের কারণে এর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। গবেষণাটিতে সেই সংকট যে বাড়ছে তা আরেকবার দেখিয়ে দিলো।
বন্যপ্রাণী বাণিজ্য পর্যবেক্ষণ সংস্থা ট্রাফিক একটি নতুন প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, সংরক্ষণ প্রচেষ্টার চেয়েও দ্রুত গতিতে অপরাধী নেটওয়ার্কগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে বন্য বাঘের সংখ্যা, যা এক শতাব্দী আগে প্রায় এক লাখ ছিল, তা বর্তমানে আনুমানিক তিন হাজার ৭০০ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজারে নেমে এসেছে।
অর্ধশতাব্দী ধরে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বিধি থাকা সত্ত্বেও, ট্রাফিক-এর গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, বাঘ পাচার ক্রমাগত বাড়ছে এবং এর লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে পূর্ণ-বাঘ— হোক তা জীবিত বা মৃত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই পরিবর্তনটি বন্দী অবস্থায় প্রজনন কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হচ্ছে। তবে এটি শিকার করার ঠিক পরেই বা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করার আগে বাঘ উদ্ধার হওয়ার কারণেও এটি হতে পারে। তারা আরও জানান, এছাড়াও এটি বিদেশি বা বিরল প্রাণী পোষার প্রবণতা বৃদ্ধি কিংবা ট্যাক্সিডার্মি (মৃত প্রাণীর চামড়ায় খড় ইত্যাদি ভরে তাকে জীবন্তের মতো সাজিয়ে রাখার শিল্প) চাহিদার কারণেও হতে পারে।
বাঘের অবৈধ বাণিজ্য নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে ট্রাফিক-এর ‘স্কিন অ্যান্ড বোনস’ সিরিজের ষষ্ঠতম এই প্রতিবেদনটি কয়েকটি স্পষ্ট প্রবণতাকে তুলে ধরেছে। ২০০০ সাল থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত, বিশ্বজুড়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দুই হাজার ৫৫১ টি উদ্ধারের ঘটনা রেকর্ড করেছে। এ উদ্ধার কার্যক্রমগুলো থেকেই উদ্ধার হয়েছে তিন হাজার ৮০৮টি বাঘ।
কেবল ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছরে, কর্তৃপক্ষ ৭৬৫ টি উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়েছে যা ৫৭৩টি বাঘ উদ্ধারের সমতুল্য, অর্থাৎ ৬৬ মাসে গড়ে মাসে প্রায় ৯টি বাঘ। সবচেয়ে খারাপ বছর ছিল ২০১৯। সেসময় ১৪১টি উদ্ধারের ঘটনা রেকর্ড করা হয়। এরপর ২০২৩ সালে রেকর্ড করা হয় ১৩৯টি উদ্ধারের ঘটনা।
সর্বাধিক উদ্ধারের ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে সেই ১৩টি দেশের মধ্যে যেখানে বন্য বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে সবার শীর্ষে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাঘ থাকা ভারত, এর পরে রয়েছে চীন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব দেশে বাঘ নেই, তাদের মধ্যে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাচার ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে আইন প্রয়োগ শক্তিশালী হয়েছে, সেখানে বাণিজ্যও তত বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবেদনটির সহ-লেখক এবং বন্যপ্রাণী অপরাধ বিশ্লেষক রামচন্দ্র ওং বলেন, “এই বৃদ্ধি আইন প্রয়োগের উন্নত প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করেছে। তবে এটি কিছু এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী এবং ক্রমবর্ধমান অপরাধমূলক কার্যকলাপ এবং বাঘ ও তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক চাহিদার ইঙ্গিতও দিচ্ছে।”
ট্রাফিকের সর্বশেষ বিশ্লেষণে একটি নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেছে,: ২০০০-এর দশকে উদ্ধারকৃত ৯০ শতাংশই ছিল বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কিন্তু ২০২০ সালের পর এটি ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর পরিবর্তে জায়গা দখল করেছে আস্ত মৃত বা জীবিত বাঘ। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলোতে ৪০ শতাংশের বেশি আস্ত বাঘ উদ্ধার করার ঘটনা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি এমন কয়েকটি সুপ্রতিষ্ঠিত হটস্পট চিহ্নিত করেছে যেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করা উচিত। এগুলো হলো: ভারত ও বাংলাদেশের বাঘ সংরক্ষণ অঞ্চলগুলো; ইন্দোনেশিয়ার আচেহ অঞ্চল; ভিয়েতনাম–লাওস সীমান্ত বরাবর অঞ্চল; এবং ভিয়েতনামের প্রধান ব্যবহার কেন্দ্রগুলো, যার মধ্যে রয়েছে এর রাজধানী হ্যানয় এবং হো চি মিন সিটি।
প্রতিবেদনটি বাঘের পাশাপাশি অন্যান্য বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীর পাচারও যে ক্রমে বাড়ছে তা উল্লেখ করেছে। তাদের ভাষ্য, প্রায় প্রতি পাঁচটি বাঘ পাচারের ঘটনায় একটিতে অন্যান্য বিপন্ন বন্যপ্রাণীও পাচার করা হচ্ছে। সাধারণত চিতা, ভালুক এবং প্যাঙ্গোলিন (বনরুই) বেশি পাচার হচ্ছে।
অঞ্চলে ভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে বাঘের ব্যবহার ও চাহিদার ধরন ভিন্ন। মেক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জীবিত বাঘের চাহিদা বেশি। তারা প্রায়শই বিদেশি প্রাণী পোষার জন্য ব্যবহার করে থাকে। ইউরোপে কিছু নির্দিষ্ট ঐতিহ্যবাহী ওষুধে ব্যবহৃত বাঘের ডেরিভেটিভস এবং সাজসজ্জার জন্য ট্যাক্সিডার্মি-র (মৃত প্রাণীর চামড়া দিয়ে তৈরি সজ্জা) জন্য একটি শক্তিশালী বাজার দেখা যায়। এশিয়া জুড়ে, ফ্যাশন এবং ঐতিহ্যবাহী ওষুধের জন্য চামড়া, হাড়, থাবা এবং সম্পূর্ণ মৃত প্রাণীর চাহিদা রয়েছে।
তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্ধারের স্থানেই তদন্ত শেষ করা উচিত নয়। এটি নির্মূলে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য, এবং গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা-ভিত্তিক, বহু-এজেন্সি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অবৈধ বাণিজ্য চেইনের অপরাধী নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া অত্যাবশ্যক।
পরিবেশগত দাতব্য সংস্থা ডব্লিউডব্লিউএফ-এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পরিচালক লেই হেনরি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, যে পূর্ণ-বাঘ পাচারের এই বৃদ্ধি “অবৈধ বাণিজ্যের প্রসার এবং তা জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে বন্দি বাঘ প্রজনন কেন্দ্রগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা”-কে তুলে ধরেছে।
তিনি বলেন, “অবৈধ বাণিজ্য এখনও বন্য বাঘের জন্য সবচেয়ে বড় তাৎক্ষণিক হুমকি হয়ে আছে। যদি আমরা অবিলম্বে বাঘ পাচারের মোকাবিলা করার জন্য বিনিয়োগের মাত্রা না বাড়াই— বিশেষত বাণিজ্যের প্রতিটি স্তরে— তাহলে আমরা বন্য বাঘ ছাড়া একটি বিশ্বের বাস্তব সম্ভাবনার মুখোমুখি হব।”