প্রথমবারের মতো হুইলচেয়ারে বসে মহাকাশ ঘুরে এলেন জার্মানির প্রকৌশলী

অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ব্লু অরিজিনের নিউ শেপার্ড ৩৭ মহাকাশ অভিযানে অংশ নিয়ে এই ইতিহাস গড়েন তিনি।

ezgif-79ba18b53eac5c10
ছবি: ব্লু অরিজিন

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে, তা আবারও প্রমাণ করলেন ৩৩ বছর বয়সী মাইকেলা বেন্টহাউস। বিশ্বে প্রথমবারের মতো হুইলচেয়ারে বসে মহাকাশের সীমানা বা ‘কারমান লাইন’ অতিক্রম করে এই জার্মান প্রকৌশলী ইতিহাস গড়েছেন। 

গতকাল শনিবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ভ্যান হর্ন লঞ্চ প্যাড থেকে ব্লু অরিজিনের ‘নিউ শেপার্ড’ রকেটে চড়ে মহাকাশে পাড়ি জমান মাইকেলা। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির অ্যারোস্পেস ও মেকাট্রনিকস প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত মাইকেলার এই যাত্রা মহাকাশ পর্যটনের ইতিহাসে এক বড় মাইলফলক।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার ওপরে কারমান লাইনকে মহাকাশের সীমানা ধরা হয়। ‘এনএস-৩৭’ নামের এই মিশনটি ছিল ব্লু অরিজিনের ১৬তম সাব-অরবিটাল মহাকাশ পর্যটন অভিযান। ২০০০ সালে অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে ব্লু অরিজিন। সংস্থাটির মূল লক্ষ্যই হলো মহাকাশযাত্রাকে সবার হাতের নাগালে নিয়ে আসা। যাতে প্রথাগত বা পেশাদার নভোচারী নন, এমন অত্যুৎসাহী মানুষেরাও মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ পান।

উড্ডয়নের আগে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাইকেলা নিজের সংশয়ের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় মহাকাশে যেতে চাইতাম। কিন্তু ভাবতাম, আমার পক্ষে এটা আসলে সম্ভব নয়। যাদের একটি পা কাটা হলেও একটু-আধটু হাঁটতে পারেন, হয়তো মহাকাশ তাদের জন্য। কিন্তু মেরুদণ্ডে চোট নিয়ে হুইলচেয়ারে বসে মহাকাশে যাওয়াটা হয়তো অনেক দূরের বিষয়।’

২০১৮ সালে মাউন্টেন বাইকিংয়ের সময় স্পাইনাল কর্ডে আঘাত পেয়ে হাঁটার শক্তি হারান মাইকেলা। তবে দুর্ঘটনা তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। প্রকৌশল ও গবেষণায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সেই প্রকৌশলবিদ্যার হাত ধরেই পৌঁছালেন মহাকাশে।

নিউ শেপার্ড ক্যাপসুলে মিকেলার এই ঐতিহাসিক যাত্রা স্থায়ী ছিল প্রায় ১০ মিনিট। শব্দের চেয়ে তিন গুণ গতির রকেটে চড়ে মাইকেলা ও তার পাঁচ সহযাত্রী কারমান লাইন পেরিয়ে যান এবং নিরাপদে ফিরে আসেন।

নিউ শেপার্ড রকেটের নকশাই এমনভাবে করা, যাতে মহাকাশের সীমানায় পৌঁছে যাত্রীরা কয়েক মিনিটের জন্য ভরশূন্যতা উপভোগ করতে পারেন। এরপর মাধ্যাকর্ষণের টানে ক্যাপসুলটি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। মাইকেলা বেন্টহাউসের জন্য এই অভিজ্ঞতা ছিল রোমাঞ্চকর, তবে চ্যালেঞ্জিংও।

উড্ডয়নের আগে তিনি জানিয়েছিলেন, সিট থেকে ওঠার সময় নিজের অসাড় পা আটকে রাখার জন্য বিশেষ একটি স্ট্র্যাপ বা ফিতা ব্যবহার করবেন। যেহেতু প্রশিক্ষণের সময় তিনি আগেই ভরশূন্য অবস্থার স্বাদ পেয়েছেন, তাই এবার কেবিনে ভেসে ভেসে ডিগবাজি খাওয়ার চেয়ে জানালার বাইরের দৃশ্য দেখাতেই তার আগ্রহ ছিল বেশি। একই সঙ্গে তার এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তার মতো অন্য শারীরিক প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটাও ছিল তার ভাবনায়।

শনিবার ব্লু অরিজিনের ক্যাপসুল থেকে বেরিয়ে মাইকেলা জানান, ওই স্ট্র্যাপ বেশ ভালো কাজ করেছে। উচ্ছ্বসিত মিকেলা বলেন, ‘দৃশ্যটা ছিল অপূর্ব! ভরশূন্য থাকার সময়টুকু তো বটেই, ওপরে ওঠার পুরো সময়টাও আমার দারুণ লেগেছে। রকেটে করে ওপরে ওঠার প্রতিটি ধাপ অনুভব করাটা ছিল এক অন্য রকম অনুভূতি।’

নিউ শেপার্ডে চড়ে কয়েক মিনিট ভেসে থাকার আনন্দ যেমন আছে, তেমনি আছে তীব্র চাপও। নামার সময় যাত্রীদের শরীরের ওপর পৃথিবীর স্বাভাবিক অভিকর্ষজ বলের পাঁচ গুণ (৫-জি) চাপ পড়ে।

ওড়ার আগে মাইকেলা জানতেন না যে ভরশূন্য অবস্থা থেকে তিনি অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের সিটে ফিরে আসতে পারবেন কি না। তাই তার সহায়তার জন্য পাশে ছিলেন স্পেস-এক্সর সাবেক নির্বাহী ও বন্ধু হান্স কনিগসম্যান। প্রয়োজনে মিকেলাকে সাহায্য করার প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন তিনি।

নিজেদের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে কনিগসম্যান বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমি ভাবিনি বিষয়টা এতটা তীব্র হবে। যতটা ভেবেছিলাম, চাপ ছিল তার চেয়েও বেশি। মহাকাশে নড়াচড়া বেশ ধীর হয়ে যায়, কিন্তু সেগুলোর প্রভাব হয় খুব শক্তিশালী।’

এই মহাকাশযাত্রার মাধ্যমে স্পাইনাল কর্ডে আঘাতপ্রাপ্তদের নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ‘উইংস ফর লাইফ’-এর জন্য তহবিল সংগ্রহ করছেন মাইকেলা।