ড্যানি রেঞ্চ: ‘দ্য কালেক্টিভ’ থেকে বেরিয়ে যেভাবে হয়ে উঠলেন অনলাইন দাবার জনপ্রিয়তার অন্যতম পথিকৃৎ

1st NOV WEB
অলঙ্করণ: সিএনএন

একসময়ের অভিজাতদের খেলা দাবাকে যারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন, অনলাইন দাবা খেলার জনপ্রিয় সাইট চেস ডট কমের সহ প্রতিষ্ঠাতা ড্যানি রেঞ্চ তাদের অন্যতম। তবে এই অবস্থানে আসার পথটা তার জন্য কখনোই মসৃণ ছিল না।  

একসময় দাবা ছিল অভিজাতদের বুদ্ধিদীপ্ত খেলা। কিন্তু এই খেলাকে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে যিনি সাহায্য করেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন দাবার জনপ্রিয়তার পেছনে যার অবদান অবিস্মরণীয়, তিনি ড্যানি রেঞ্চ। 

Chess.com-এর প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে তিনি এখন নিজেকে দাবার ‘পালক’ হিসেবে দেখেন। তবে এই অবস্থানে আসার পথটা তার জন্য কখনোই মসৃণ ছিল না, বরং ছিল উত্থান-পতনে ভরা এক অবিশ্বাস্য যাত্রা।

সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথা, ‘ডার্ক স্কয়ার্স: হাউ চেস সেইভড মাই লাইফ’ উন্মোচন করেছে তার জীবনের এক অপ্রত্যাশিত ও কষ্টকর অধ্যায়। রেঞ্চের বর্ণনা অনুযায়ী, তার শৈশব কেটেছে অ্যারিজোনার ‘চার্চ অফ ইমর্টাল কনশাসনেস’ নামের এক ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর (যা ‘কালেক্টিভ’ নামে পরিচিত ছিল) মধ্যে। বাইরে থেকে মনে হতো এটি এক আদর্শবাদী সমাজ, যেখানে শিশুরা সমবয়সীদের সাথে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করত, জঙ্গলে বা পানিতে খেলে দিন কাটাতো। 

পঞ্চদশ শতাব্দীর পহলভন ডুরানের শিক্ষা অনুসরণের দাবিদার এই গোষ্ঠীটি দিশেহারা আত্মাদের ‘উদ্দেশ্য’ দেওয়ার কথা বলত। স্টিভেন ও ট্রিনা ক্যাম্প পরিচালিত এই ‘কালেক্টিভ’ নিয়মিত ‘প্রসেসেস’ নামক সভা আয়োজন করত, যেখানে সদস্যদের আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা যাচাই করা হতো। 

রেঞ্চের স্মৃতিচারণ অনুযায়ী, এই সভাগুলো প্রায়শই মদ্যপানের কারণে উচ্চস্বরে বিতর্কে রূপ নিত। এমনকি একে অপরের মুখে তরল ছুড়ে মারাও (যাকে তারা ‘গ্লাসড’ বলত) ছিল এক স্বাভাবিক ঘটনা।

ড্যানি (হলুদ জামায়) স্টিভেন ক্যাম্প ও শেলবি স্কুলের দাবা দলের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে। ছবি: ড্যানি রেঞ্চের সৌজন্যে

রেঞ্চ উপলব্ধি করেছিলেন, সমতাবাদী সমাজের কথা বলা হলেও ‘কালেক্টিভে’র ভেতরে ছিল কঠোর স্তরবিন্যাস। জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উক্তি ‘সব প্রাণী সমান, কিন্তু কিছু প্রাণী অন্যদের চেয়ে বেশি সমান’ – এই বাস্তবতাকে তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন। 

কাল্ট বিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্টিভেন হাসান  জানান, এই ধরনের গোষ্ঠী সদস্যদের মধ্যে ‘বিভ্রম জনিত ব্যাধি এবং পরিচয়ের বিভ্রাট’ সৃষ্টি করতে পারে। হাসান নিজেও একসময় এমন একটি বিতর্কিত ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন।

সাধারণ শিশুর মতোই জীবন কাটানো ড্যানি রেঞ্চের জীবনে মোড় আসে ‘সার্চিং ফর ববি ফিশার’ ছবিটি দেখার পর। দাবা খেলাটি তাকে মুহূর্তেই গ্রাস করে। শুরু থেকেই তিনি এতে দারুণ পারদর্শী ছিলেন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজে নিজে শিখে দ্রুতই চার্চের প্রধান স্টিভেন ক্যাম্পের নজরে আসেন।

স্টিভেন নিজেও দাবার ভক্ত ছিলেন, রেঞ্চের মধ্যে অপার সম্ভাবনা দেখেছিলেন। কিন্তু রেঞ্চ পরে বুঝতে পারেন, স্টিভেন তার দাবার দক্ষতাকে ‘কালেক্টিভ’-এর শিক্ষাগুলোকে বৈধতা দেওয়ার এবং গোষ্ঠীর কার্যকলাপকে সমর্থন করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করতেন। 

স্টিভেন ক্যাম্প নিজ উদ্যোগে রেঞ্চের দাবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন, এমনকি সাবেক সোভিয়েত দলত্যাগী ইগর ইভানভকেও প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য অর্থ ও পরিবহনেরও ব্যবস্থা করা হয়। 

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ক্যাম্পের সেই নির্দেশনা, যেখানে তিনি রেঞ্চকে জানান যে দাবাই তার জীবনের ‘উদ্দেশ্য’। ফলে, একটি খেলার ওপর চাপানো হয় এক ধর্মীয় গুরুত্ব।

দাবার ওপর এই অতিরিক্ত চাপ খেলাটির প্রতি রেঞ্চের স্বাভাবিক আনন্দদায়ক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়। তিনি স্মরণ করেন, শাস্তি পাওয়ার সময় তার মনে হতো যেন এই জীবনে দাবার পেছনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা না দিলে তাকে নরকে যেতে হবে। 

এই প্রবল মনোযোগের ফলে রেঞ্চ দ্রুতই টুর্নামেন্ট বিজয়ী ও দাবার বিস্ময়বালকে পরিণত হন। তিনি অ্যারিজোনার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ জাতীয় দাবা মাস্টার এবং বহুবারের জাতীয় শিক্ষামূলক দাবা চ্যাম্পিয়ন হন।

কিন্তু এই সাফল্যের এক নির্মম মূল্য ছিল। রেঞ্চের ভাষ্যমতে, স্টিভেন ক্যাম্প তাকে দাবার জগতে আরও গভীরভাবে ঠেলে দিতে থাকেন, পরিণাম যাই হোক না কেন। একটানা বিমান ভ্রমণ ও উচ্চতার পরিবর্তনের কারণে রেঞ্চ ‘টিনিটাস’ (কানে একটানা শব্দ হওয়ার রোগ)-এ আক্রান্ত হন, যা পরবর্তীতে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ও সংক্রমণে রূপ নেয়।

ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল মায়ের কাছ থেকে তার বিচ্ছিন্ন হওয়া। রেঞ্চের দাবার ভবিষ্যৎ সাফল্যকেই এই নির্মম বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ স্টিভেন হাসান জানান, কাল্টগুলোতে শিশুদের পিতামাতা থেকে আলাদা করে দেয়া (প্যারেন্ট অ্যালিয়েনেশন) একটি সাধারণ চর্চা।

এই ‘কালেক্টিভ’-এর জীবন এবং দাবার জগৎ থেকে সরে আসার পরও রেঞ্চের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো বাড়তে থাকে। স্ত্রী শনা’র সাথে দেখা হওয়া এবং তাদের সন্তান হওয়ার পরেও তিনি অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তির সাথে লড়াই করেছেন। 

অবশেষে তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পরপরই তিনি ‘কালেক্টিভ’ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। 

জীবনের বেশিরভাগ সময় এই দলটির সাথে কাটানোর পর এই বিচ্ছেদ সহজ ছিল না। রেঞ্চ বলেন, আসক্তিমূলক আচরণ এবং প্রায় ভাঙতে বসা বিয়েকে কোনোমতে রক্ষা করার মতো কঠিন পরিস্থিতি তাকে পার করতে হয়েছে।

২০০৯ সাল নাগাদ রেঞ্চ Chess.com-এ কোচিং শুরু করেন। Chess.com-এর এই অসাধারণ বৃদ্ধির পেছনে রেঞ্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তবে জীবনের এতো কষ্ট ও আঘাত সত্ত্বেও রেঞ্চের মনে কোনো ক্ষোভ নেই। তিনি বিশ্বাস করেন, তার অতীত জীবনের সংগ্রামগুলো জীবনের এক সমৃদ্ধ ক্যানভাসের অংশ। 

রেঞ্চ বলেন, ‘দুঃখ ও কষ্ট থেকে আমরা শিখতে পারি, এটি আমাদের যা আছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধও জাগায়। আমার জীবনের এই যাত্রায় কষ্ট আমাকে শিখিয়েছে যে, আপনার সম্পর্কগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যের সাথে সংযোগ স্থাপন করাই আপনার উদ্দেশ্য পূরণ করে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য আমার কাজের মধ্যে নেই। এটি আমার অনুভূতিতে এবং কেন আমি তা করি, তার মধ্যেই নিহিত। আমি এই সত্যে বিশ্বাস করি যে, আমার সাথে যা ঘটেছে, আমি তা নই। আমি যা হওয়ার জন্য বেছে নিয়েছি, আমি তাই। এবং এই দর্শনকে আমি আমার প্রতিটি কাজে এবং Chess.com-এ আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে ধারণ করার চেষ্টা করি।’