অদৃশ্য হাত: মানুষের স্বার্থ আর সমাজ গড়ে ওঠার দীর্ঘ অনুচ্চারিত কাহিনি

এই মানুষটি অ্যাডাম স্মিথ, দার্শনিক অর্থনীতিবিদ। ১৭২৩ সালে জন্ম, মৃত্যু ১৭৯০। তিনি এমন একজন চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন, যাকে বন্ধুরা প্রায়ই দেখেছে হাঁটতে হাঁটতে নিজের সঙ্গেই কথা বলেছেন। একবার তিনি নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছেন। আর ঘুরতে ঘুরতে একসময় শহর ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছেন বহু মাইল দূরে। ১২ মাইল দূরে। পরদিন যখন গির্জার ঘণ্টাধ্বনি কানে গেলে ‘হুঁশ’ ফিরে আসে। তিনি বুঝতে পারেন, নিজের অবচেতন মনের ভাবনার জেরে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন।

4th DEC WEB
অ্যাডাম স্মিথ

স্কটল্যান্ডের উপকূলীয় নিস্তব্ধ শহর কার্কলডি। কুয়াশায় মোড়ানো এক ভোরে শহরের মানুষ অবাক হয়ে দেখল, একজন ব্যক্তি রাস্তার মাঝ বরাবর হাঁটছেন। অবাক হওয়ার কারণ তার অদ্ভুত চলাফেরা নয়, বরং তার চারপাশের পৃথিবীর প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা। তিনি হাঁটছেন, কিন্তু যেন হাঁটছেন না। মুখে গভীর চিন্তার ছাপ, চোখ আধো খোলা, ঠোঁট যেন অবচেতন মনের কথা বলছে। মাঝে মাঝে তার পদক্ষেপ থেমে যায়, আর তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন দূর আকাশের দিকে, যেন সেখানে লেখা আছে কোনো অদৃশ্য সূত্র, যা তিনি পড়তে পারছেন। 

এই মানুষটি অ্যাডাম স্মিথ, দার্শনিক অর্থনীতিবিদ। ১৭২৩ সালে জন্ম, মৃত্যু ১৭৯০। তিনি এমন একজন চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন, যাকে বন্ধুরা প্রায়ই দেখেছে হাঁটতে হাঁটতে নিজের সঙ্গেই কথা বলেছেন। একবার তিনি নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছেন। আর ঘুরতে ঘুরতে একসময় শহর ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছেন বহু মাইল দূরে। ১২ মাইল দূরে। পরদিন যখন গির্জার ঘণ্টাধ্বনি কানে গেলে ‘হুঁশ’ ফিরে আসে। তিনি বুঝতে পারেন, নিজের অবচেতন মনের ভাবনার জেরে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। 

এই অদ্ভুত মনোযোগের মধ্য দিয়ে কাটছিল তার জীবন। নিকট কিছুই যেন তাকে টানছে না। মনোযোগ রয়েছে সুদূরের কিছুতে। এরও কারণ ছিল। সে সময় তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজে মেতেছিলেন। তিনি তখন লিখছেন ‘দ্য ওয়েলথ অব নেশনস’। এমন একটি বই, যা আধুনিক অর্থনীতিকে শুধু বদলই করেনি। বরং মানুষের আচরণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক, বাজারের রহস্যময় চালচিত্র–সবকিছুকেই নতুন আলোয় দেখিয়েছে। বইটি প্রকাশিত হয় ১৭৭৬ সালে। কেউ কেউ বলেন বইটি শুধু অর্থনীতির তত্ত্ব নয়; এটি মানবসভ্যতার ভেতরে লুকিয়ে থাকা আচরণের আদিম নকশা বোঝার এক প্রচেষ্টা। 

স্মিথ দিনরাত জেগে লিখছেন, বাড়ির ভেতর হাঁটছেন, কাগজ ছিঁড়ছেন, আবার শুরু করছেন। ঘনিষ্ঠজনেরা বলতেন, স্মিথ যখন চিন্তায় ডুবে যেতেন, তখন যেন তার শরীরটা শুধু খোলস হয়ে থাকত। তার মগজ সে সময় ভেতরে ভেতরে নতুন পৃথিবী নির্মাণে মগ্ন। মানুষের স্বভাব নিয়ে তার বিভ্রান্তি ছিল না। তিনি জানতেন, মানুষ নিজের স্বার্থ নিয়ে বাঁচে। নিজেকে ভালো রাখতে চায়। নিজের প্রয়োজন মেটাতে চায়। তাই তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি তুললেন, মানুষ যদি নিজ স্বার্থ দেখেই চলে, তাহলে কীভাবে সমাজ টিকে থাকে! 

নদী তীরে তৈরি হচ্ছে ধোঁয়া ছড়ানো কারখানা, কলের শব্দ নতুন সমাজের জন্ম বার্তা দিচ্ছে।

জবাবে তিনি টেনে আনলেন সবচেয়ে আটপৌরে উদাহরণ। লেখার টেবিল ছাড়িয়ে স্মিথ তাকালেন চারপাশের সাধারণ জীবনযাপনের দিকে। প্রতিদিন সকালে আপনি বাজারে গেলে রুটি কিনতে পারেন। কসাইয়ের দোকান থেকে গোশত কিনতে পারেন। (পশ্চিমের মানুষের জন্য প্রযোজ্য) বিয়ারের বোতল প্রস্তুত থাকে। এই সব কাজ মানে কি যে কসাই, রুটি বা মদ প্রস্তুতকারী আপনাকে ভালোবাসে বা আপনার উপকার করতে এক পায়ে খাড়া? নিশ্চয়ই না। 

তারা নিজ নিজ স্বার্থে দোকান খুলেছে। তাদের প্রয়োজন আপনার টাকাকড়ি বা মুদ্রা। আর আপনার প্রয়োজন তাদের পণ্য। প্রত্যেকে নিজের স্বার্থে কাজ করছেন। কিন্তু সেই স্বার্থের মিলন থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে সমাজের স্থিতি। অ্যাডাম স্মিথ বললেন, এই স্বাভাবিক প্রবাহই হলো অদৃশ্য হাত। এটি কোনো বাস্তব হাত নয়। এটি কোনো রাজা, কোনো সরকার বা কোনো কেন্দ্রীয় শক্তিও নয়। এটি মানুষের স্বার্থের সম্মিলিত ক্রিয়া। এই ক্রিয়া সমাজকে একটি সুন্দর ও কার্যকর উপায়ে সমন্বিতভাবে ধরে রাখে। তিনি উদাহরণ দিলেন ফুটবল দলের। একটি দল ভালো খেলতে হলে শুধু একজন তারকা খেলোয়াড়ই প্রয়োজন হয় না। দলের রক্ষণ, মাঝমাঠ, আক্রমণ এমনকি গোলরক্ষক–প্রত্যেকেই তাদের নিজের কাজ ঠিকমতো করলেই দল জেতে। সব খেলোয়াড় যদি বলের দিকে ছোটে এবং এককভাবে নিজেই শুধু গোল করতে চায়, তাহলে? মাঠে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, দল ভেঙে পড়বে। 

সমাজও ঠিক এভাবেই চলে। হাজার মানুষের হাজার কাজ, সবই ছোট ছোট, খুব সাধারণ, কেউ কারও নাম জানে না। কিন্তু প্রত্যেকে নিজের কাজ করতে করতে সমাজ নামের বড় ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে থাকে। আপনি দোকান থেকে দুধ কিনছেন। কারণ, দোকানদার জানে আপনি সকালে দুধ চাইবেন। সে দুধ রাখা শুরু করল। কারণ, তার মনে হলো লোকজন দুধ কিনবে। তাকে রাষ্ট্র বলে দেয়নি দুধ রাখতে হবে। তার স্বার্থ তাকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। আপনি দুধ কিনলে তার ব্যবসা চলে। সে দুধ এনেছে আপনার প্রয়োজনের জন্য। এভাবে নিজের নিজের উদ্দেশ্য নিয়ে চলতে চলতে আপনারা দুজনই সমাজের বড় চাকাকে আরও ভালোভাবে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। 

অ্যাডাম স্মিথ কখনোই বলেননি যে লোভ ভালো। বরং তিনি পরিষ্কার করে বললেন, স্বার্থ আর লোভ এক জিনিস নয়। স্বার্থ মানে নিজের প্রয়োজন সচেতনভাবে মেটানো। লোভ মানে অন্যের ক্ষতি করে নিজের লাভ তোলা। স্বার্থ সমাজকে সুস্থ রাখে। অন্যদিকে লোভ এই সমাজকেই ভেঙে দেয়। তিনি দেখালেন, বাজারের ভেতর সৎ থাকার প্রয়োজনটিও স্বার্থের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। একজন রুটি প্রস্তুতকারক যদি নিম্নমানের রুটি বানায়, তার খদ্দের আর ফিরবে না। একজন মদ প্রস্তুতকারী যদি নিয়ম ভেঙে মদে পানি মেশায়। মানুষ সেটা টের পাবে। আর দোকানদার তার সুনাম হারাবে। একজন ব্যবসায়ী যদি প্রতারণা করে, তবে বাজার তাকে শাস্তি দেবে। কারণ, বাজার সব সময় বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। নৈতিকতা তাই সমাজে টিকে থাকে। টিকে থাকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং মানুষের স্বার্থের চাপে। মানুষ বুঝে নিজের স্বার্থকে লাভবান করে সততাই। 

স্মিথ যেটা দেখলেন, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণের পথ তৈরি হয় শিল্পবিপ্লবের শুরুর মধ্য দিয়ে। ব্রিটেন তখন বদলে যাচ্ছে। নদী তীরে তৈরি ধোঁয়া ছড়ানো কারখানা মেশিন আর কলের শব্দ সবই নতুন সমাজের জন্মবার্তা দিচ্ছে। লোকেরা বুঝতে পারছে উৎপাদনের পদ্ধতি বদলে গেলে কাজের প্রকৃতি বদলে যায়। কাজের প্রকৃতি বদলালে সমাজই বদলে যায়। তিনি গভীরভাবে লক্ষ করলেন শ্রম বিভাগের শক্তি। 

তিনি দেখলেন, একজন মানুষ যখন নিজে নিজে কিছু তৈরি করতে যায়, সে দিনে হাতে গোনা কয়েকটি জিনিসই তৈরি করতে পারে। তিনি উদাহরণ দিলেন পিনের। একজন কারিগর যদি একা একটি পিন বানাতে চায়, তাহলে তার সারা দিন লেগে যাবে। তাকে তার কাটতে হবে। ধার করতে হবে। মাথা লাগাতে হবে। প্যাকেট করতে হবে। কিন্তু যদি এই কাজগুলো ভাগ করে দেওয়া যায়, যদি দশজন মানুষের প্রত্যেকে একেকটি ধাপ সামলায়; তাহলে দিনের শেষে তৈরি হবে শত শত পিন। হাজার হাজারও হতে পারে। এর ফলে দক্ষতা বাড়ে। সময় বাঁচে। উৎপাদন বাড়ে। সমাজ সমৃদ্ধ হয়। স্মিথ দেখলেন শ্রম বিভাগ শুধু উৎপাদন বাড়ায় না, মানুষকে তার কাজে দক্ষ করে তোলে। 

এই দক্ষতাই পুরো সমাজের সম্পদ বাড়িয়ে দেয়। এই দক্ষতা মানুষের জীবনকে সহজ করে। পণ্যের দাম কমায়। বাজারকে প্রসারিত করে। এর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের শক্তিও বেড়ে যায়। তিনি বুঝলেন, একটি সমাজ যত বেশি শ্রম বিভাগে উন্নত হয়, সেখানে নতুন পণ্য তত বেশি জন্ম নেয়, তত বেশি মানুষের জীবনের আরাম বাড়ে। তত বেশি সংস্কৃতি এবং জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে। সমাজ যেন এক বিশাল বয়নযন্ত্র। প্রত্যেক মানুষ একেকটি সুতোর মতো। যারা আলাদা আলাদা কাজ করে। কিন্তু মিলেমিশে তৈরি করে এক বিশাল নকশা। এই নকশাই হলো সভ্যতা। 

সভ্যতার ভেতরের গতিকে চালায় অদৃশ্য হাত। এত সব বিশাল চিন্তার মাঝেও স্মিথ কখনো ভুলে যাননি মানুষ কেবল অর্থনীতির যন্ত্র নয়; মানুষের অনুভূতি আছে, দায়িত্ব আছে, সহমর্মিতা আছে। তাই সমাজের শক্তি তৈরি হয় স্বার্থ আর মানবিকতার জটিল মিশ্রণে। এটাই তার বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রার প্রথম অধ্যায়।

অর্থনীতির গল্প মানে শুধু সংখ্যার গল্প নয়। এটি একেক মানুষকে কেন্দ্র করে বোনা হাজারো সম্পর্কের গল্প। অ্যাডাম স্মিথ যখন প্রথম পর্বে আলোচিত তার বড় তত্ত্ব তৈরি করছিলেন, তখন তার মন ছিল উদ্বিগ্ন। তিনি বুঝেছিলেন পৃথিবী বদলে যাচ্ছে এবং সেই বদলের ভেতর দাঁড়িয়ে মানুষ শুধু অর্থনৈতিক সত্তা নয়, বরং এক জটিল আবেগ, প্রয়োজন, ভয় এবং স্বপ্নের প্যাকেজ। কারখানার ঘড়ির টিকটিক শব্দ তখনো স্কটল্যান্ডে তেমন শোনা যেত না। কিন্তু লন্ডন ম্যানচেস্টার বার্মিংহামের মতো শহরগুলো ইতিমধ্যেই প্রযুক্তির নতুন হাওয়ায় গমগম করতে শুরু করেছে। ছোট্ট সুতি মিলগুলো বড় বড় ইস্পাত কারখানায় পরিণত হচ্ছে। চিমনি থেকে ওঠা ধোঁয়া আর মেশিনের শব্দ যেন ঘোষণা করছে, মানুষ আর শুধুই কৃষিজীবী প্রাণী নয়, সে এখন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করবে। 

যন্ত্রশাসিত এই পৃথিবীই পরে পরিচিত হলো শিল্পবিপ্নব বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন নামে। মানুষের জীবনযাত্রার এমন দ্রুত পরিবর্তন ইতিহাসে আর খুব বেশি দেখা যায় না। শতাব্দীর পর শতাব্দী স্থির থাকা গ্রামের জীবন হঠাৎ করে ভেঙে পড়ে। চেনাজানা খেতখামার, ভেড়ার পাল, পুরোনো কুটির ঘর–এসব যেন হঠাৎই অচেনা হয়ে যায়। মানুষের কাজের জায়গা বদলায়, পরিবার থেকে দূরে সরে যায়, এমনকি নিজের পরিচয়ের মধ্যেও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। 

অ্যাডাম স্মিথ এই ঝড়ের শব্দ দূর থেকে শুনছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন মানবসমাজের বুকে নতুন এক দানব জন্ম নিচ্ছে। অর্থনীতি নামের সেই দানবকে থামানো যাবে না। বরং বুঝে নিতে হবে কেমন করে সে কাজ করবে, কী তাকে চালায় এবং মানুষের মঙ্গল কীভাবে এর ভেতরেই খুঁজে নিতে হবে। যে অদৃশ্য হাত তিনি আগের অংশে তুলে ধরেছিলেন, এবার সেই হাতকে দেখা যাবে আরও বেশি স্পষ্টভাবে। 

শ্রম বিভাগের বিস্ময় শিল্পবিপ্লবের জন্মদাতা যন্ত্রের যুগ শুরু হতেই শ্রম বিভাগের ধারণা শুধু তত্ত্বে নয়, বাস্তবেও রূপ পেল। আগে যেখানে একজন কারিগর পুরো কাজ একা করত, শিল্পবিপ্লব এসে বলল, কাজকে ভেঙে আরও ছোট ছোট অংশে পরিণত করো। একটি পিন তৈরি করার উদাহরণটি তখন শুধু বইয়ের নিদর্শন নয়; দেশজুড়ে গড়ে ওঠা শত শত কারখানায় একই সূত্র প্রয়োগ হলো। যে শ্রমিক সারা জীবন কাঠ কাটছিলেন, তিনি এখন একটি যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই স্ক্রু ঘোরাতে লাগলেন। যে নারী আগে বুনন করতেন, তিনি এখন সুতি মেশিন চালাচ্ছেন অবিশ্বাস্য গতিতে। হাতে আর কাঁচি নেই, আছে মেশিনের লোহার শব্দ। কাজ ভাগ হলে মানুষের দক্ষতা বাড়ে। এটি সত্য। 

কিন্তু স্মিথ বুঝলেন, এর পেছনে আরও গভীর কিছু লুকিয়ে আছে। দক্ষতা বাড়ার পাশাপাশি মানুষ নিজেকে হারাতে থাকে। একঘেয়েমি কাজ মানুষকে যন্ত্রের মতো বানিয়ে ফেলে। আমাদের মস্তিষ্ক নতুন কিছু শিখতে চায়, বৈচিত্র্য চায়, সৃজনশীল কাজ চায়। শ্রম বিভাগ এসব কেড়ে নিলেও মানুষের আয়ু কমিয়ে দেয় না, তার চিন্তাশক্তি কমিয়ে দেয়। একসময় গ্রাম্য কারিগর তার বানানো চেয়ার দেখে গর্ব করত। এখন সে পালিশ করছে চেয়ারের শুধু বাঁ দিকের হাতল। চেয়ারের বাকিটা আর দেখা হয় না। চেয়ারটি সম্পূর্ণ তার হাতে তৈরি নয়। 

এই বঞ্চনা শ্রম বিভাগের আরেক অদৃশ্য মূল্য। মানুষ বদলায়, সমাজ বদলায়, বাজার বদলায়; স্মিথ বুঝলেন, বাজার মূলত মানুষের স্বভাব দেখে তৈরি। মানুষ চায় লাভ, চায় নিরাপত্তা, চায় নিজের প্রয়োজন মেটাতে। কিন্তু সে তার পরিবারের ভালো চায়, চায় ন্যায্যতা। এই প্রতিটি চাহিদা বা আকাক্সক্ষার মিশ্রণই সমাজকে চালায়। শিল্পবিপ্লব এসে মানুষকে শহরমুখী করল। কৃষক পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, তরুণেরা শহরে ছুটছে নতুন কাজের আশায়। শহরগুলো দ্রুত বদলাচ্ছে–অলিগলি ভরে গেল অন্ধকার কারখানায়, রাস্তা দিয়ে রাতভর ছুটল ঘোড়ার গাড়ি, মজুরেরা ঘুমাল গাদাগাদি করে শ্রমিক কুঠিরে। মানুষের জীবন হয়ে ওঠে এক নতুন যান্ত্রিক সময়ের দাস। সকাল হলেই কারখানার সিটি বাজে। সবাই ছুটে যায় কাজে। রাতে ক্লান্ত মানুষ ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার পরদিন একই চক্র। এ কেমন সমাজ তৈরি হলো? এ কি সেই সমাজ, যেখানে সবাই নিজের স্বার্থে কাজ করলেও সমাজের খাতে মঙ্গল জমে? নাকি স্বার্থের খোঁজে মানুষের ভেতরের মানবিকতা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়? 

অ্যাডাম স্মিথ প্রথমে ভেবেছিলেন, বাজার সব সময় সমাজকে সামঞ্জস্যে রাখবে। কিন্তু শিল্পবিপ্লব তাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করল। তিনি দেখতে পেলেন, বাজারের ক্ষমতা সব সময় সবার মঙ্গল সৃষ্টি করে না। বাজারের হাতে নিয়ন্ত্রণ গেলে ধনী আরও ধনী হয়। গরিব মানুষেরা কঠিন যন্ত্রের নিচে পিষ্ট হয়। স্বার্থ কতটা পবিত্র, কতটা বিপজ্জনক? 

স্মিথ বললেন স্বার্থ মানুষের স্বভাবের অংশ। স্বার্থ তাকে কাজ করতে শেখায়। স্বার্থ তাকে সৎ হতে বাধ্য করে। স্বার্থ থেকেই সমাজে সমন্বয় জন্মায়। কিন্তু স্বার্থ যদি কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বেড়ে ওঠে, তাহলে সেটি একসময় লোভে পরিণত হয়। এই লোভ জন্ম দেয় শোষণ, জন্ম দেয় অন্যায্য মজুরি, জন্ম দেয় বাজার একচেটিয়া হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি। যে অদৃশ্য হাত মানুষকে চালায়, সেই হাত একসময় ছায়া হয়ে ভয়ও সৃষ্টি করতে পারে। 

অ্যাডাম স্মিথ তার বইয়ে স্পষ্টভাবে বললেন, রাষ্ট্রকে তাই বাজারের ওপর নজর রাখতে হবে। রাষ্ট্র যেন প্রয়োজনীয় জায়গায় হস্তক্ষেপ করে। শিক্ষার ব্যবস্থা করে, রাস্তাঘাট বানায়, বন্দর উন্নত করে, সুরক্ষা দেয়, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে। রাষ্ট্র ও বাজারের এই ভারসাম্যই আধুনিক পৃথিবীর ভিত্তি। একদিকে বাজার স্বাধীন থাকবে, যাতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়, নতুন চিন্তা জন্ম নেয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণ করবে, যাতে স্বার্থের পারস্পরিক সংঘর্ষ সমাজকে ধ্বংস না করে। এ দ্বৈত ব্যবস্থার ভেতরই আধুনিক অর্থনীতি জন্ম নিল। 

বৈষম্যের শেকড় সমাজের অচেনা যন্ত্রণা স্মিথ দেখলেন, শিল্পবিপ্লবে জন্ম নেওয়া সমাজে একটি ভয়ংকর নতুন বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। ধনী ব্যবসায়ীরা তখন শুধু একটি কারখানার মালিক নয়, বারোটি কারখানার মালিক। একটি মিল নয়, শহরজুড়ে গোডাউন। তাদের ক্ষমতা রাষ্ট্রের ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। অন্যদিকে দরিদ্র শ্রমিকেরা গ্রাম ছাড়ে, শহরও তাদের জায়গা দেয় না। কারখানার মালিক বলবে, তোমার কাজ লাগলে থাকবে, না লাগলে দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। নতুন লোক অপেক্ষায় আছে। এই অবস্থায় অদৃশ্য হাত সমাজকে সামঞ্জস্যে রাখবে কীভাবে? যেখানে কিছু মানুষের হাতে সব পুঁজি, আর অধিকাংশ মানুষের হাতে শুধু সময় আর শ্রম। 

এই বিরোধ স্মিথকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গেল। তিনি দেখলেন মানুষ কেবল বাজারের অংশ নয়, মানুষের ভেতরে নৈতিকতারও বাস। বাজার যদি মানুষকে মানুষ হতে ভুলিয়ে দেয়, তাহলে অদৃশ্য হাত শুধু অর্থনীতিকে এগিয়ে নিলেও মনুষ্যত্বকে পিছিয়ে দেবে। স্বার্থের ভেতর মানুষের স্বপ্ন ও ব্যথা–শিল্পবিপ্লবের প্রতিটি পরিবারে তখন ছিল দুটি গল্প। একটি গল্প ছিল উন্নতির। শহরে নতুন বসতি, গ্যাসের আলোয় আলোকিত রাস্তা। বড় বড় গ্রন্থাগার তৈরি হওয়া। কাগজে ছাপা সংবাদ। বাণিজ্যে উত্থান। 

আরেকটি গল্প ছিল অদৃশ্য ব্যথার। শিশুর ক্লান্ত চোখ, নিরুপায় শ্রমিক, দীর্ঘ যন্ত্রের শব্দে হারিয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের শান্তি। স্মিথ এগুলো সবই দেখলেন তার সময়েই। তার লেখনীর ভেতর দিয়ে আমরা বুঝতে পারি, অদৃশ্য হাত কখনো আশীর্বাদ, কখনো অভিশাপ। এটি নির্ভর করে মানুষ নিজের স্বার্থ বুঝে ব্যবহার করছে কি না। পাশের মানুষটির স্বার্থকে সমান মর্যাদা দিচ্ছে কি না। রাষ্ট্র  যথাযথ জায়গায় দায়িত্ব পালন করছে কি না। অদৃশ্য হাত ছিল শক্তি, কিন্তু তা সব সময় আলোকময় নয়। স্মিথ বললেন যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে যেমন জ্ঞান বাড়ে, তেমনি ভুল বোঝাবুঝিও বাড়ে। বাজার বড় হলে যেমন সুযোগ বাড়ে, তেমনি শোষণও বড় হয়। অর্থনীতির প্রতিটি সফল যন্ত্রের ভেতর মানুষের আশা ও ভয়–দুটোই মিশে থাকে। তাই অদৃশ্য হাত কখনো অদৃশ্য পথপ্রদর্শক, আবার কখনো ছায়াময় বিচারক। এ দ্বৈত চরিত্র বুঝতে না পারলে সমাজ শুধু বড় হয়, ভালো হয় না।  

বইয়ের পাতায় অ্যাডাম স্মিথের চিন্তাভাবনা যতটা শান্ত দেখায়, বাস্তবে তিনি ততটাই অস্থির ছিলেন। তার মন ছিল প্রশ্নে প্রশ্নে ভরা। মানুষ কি সত্যিই নিজের স্বার্থের ভেতর অন্যের উপকার খুঁজে পায়? নাকি সমাজ এমন এক নাজুক কাঠামো, যার সামান্য চাপেই ফাটল দেখা দেয়? এসব প্রশ্নের জন্ম হয়েছিল তার সময়কার দ্রুত বদলে যাওয়া পৃথিবী থেকে। 

তিনি দেখেছিলেন, মানুষ নিজের স্বার্থে বাঁচে, কিন্তু সেই স্বার্থ কখনো মঙ্গল আনে, কখনো আবার ছায়া ফেলে। শিল্পবিপ্লবের প্রথম ধাক্কায় সমাজে যে বিশাল অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা স্মিথের চিন্তাচক্রে প্রবল প্রভাব ফেলেছিল। তার প্রথম প্রতীতি ছিল–মানুষকে দমিয়ে দেওয়া যাবে না। সে স্বাধীন হলে তার সৃজনশীলতা খুঁজে পাবে। বাজার স্বাধীন থাকলে উৎপাদন বাড়বে, মানুষ তার প্রয়োজন মেটাতে পারবে, সমাজ এগোবে। কিন্তু তিনি যতই মানুষের আচরণ বুঝতে চেষ্টা করলেন, ততই বুঝলেন ব্যাপারটি এত সরল নয়। স্বার্থের ভেতর যত আলো আছে, তত অন্ধকারও আছে। এক দিনের লাভ কখনো কখনো দীর্ঘ মেয়াদে সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একটি কারখানা দ্রুত কাজ করার জন্য শ্রমিকদের জীবন চেপে ধরলে এটি স্বার্থ হলেও মঙ্গল নয়। একজন ব্যবসায়ী মুনাফা বাড়াতে খাদ্যে ভেজাল দিলে এটি বাজারের লড়াই হলেও সভ্যতার পতন। 

স্মিথ তাই বুঝলেন, মানুষ যদি শুধু স্বার্থেই চলে, তবে খুব সহজেই তার বিবেক ক্ষয়ে যেতে পারে। এই ক্ষয় পুরো সমাজকে আঘাত করে। কেউ চাইলে তার দোকানের দামে বাড়তি চাপ বাড়িয়ে অল্প সময়ে লাভ করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সে জন-আস্থা হারাবে। কেউ চাইলে শ্রমিকের মজুরি কমিয়ে আরও মুনাফা কামাতে পারে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে শ্রমিকদের ক্লান্তি সেই উৎপাদনকেই আঘাত করবে। অদৃশ্য হাত কাজ করে, এ কথা সত্য। কিন্তু অদৃশ্য হাতকে পথ দেখানোর জন্য দরকার দৃশ্যমান নীতি। 

এ নীতি হলো নৈতিকতা, শিক্ষালাভ, এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিবেক নামের অদৃশ্য আলো অ্যাডাম স্মিথের আরেকটি বই আছে–’দ্য থিওরি অব মোরাল সেন্টিমেন্টস’। বইটির মূল কথা, মানুষের ভেতরে স্বার্থ যেমন আছে, তেমনি আছে সহানুভূতি। একজন মানুষ অন্যের কষ্ট দেখলে ব্যথা পায়। অন্যের আনন্দ দেখলে হাসে। এই সহানুভূতিই তাকে স্বার্থের সীমা টেনে দিতে শেখায়। মানুষ শুধু বাজারের যন্ত্র নয়। মানুষের ভেতরে থাকে একটি অভ্যন্তরীণ বিচারক। স্মিথ তাকে বললেন, ইম্পার্শিয়াল স্পেকটেটর, অর্থাৎ পক্ষপাতহীন দর্শক। এই দর্শক আমাদের বলে, তুমি যা করছ, তা ঠিক কি ঠিক না। তোমার স্বার্থ অন্যের ক্ষতি করছে কি না। এই নৈতিক দর্শক–অদৃশ্য হাতের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। 

তাই তিনি জানতেন, বাজার যত বড় হবে, নৈতিকতা ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ, অর্থনীতির জটিলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভুল করার সুযোগও বাড়ে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় উত্থান শিল্পবিপ্লবের কুয়াশামাখা সময় স্মিথকে দেখিয়েছে কিছু কিছু জায়গায় বাজার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বাজার কখনো কখনো শিক্ষা নিয়ে ভাবে না। বাজার সব সময় স্বাস্থ্যসেবাকে গুরুত্ব দেয় না। বাজার রাস্তাঘাট, সেতু, বন্দর তৈরি করার কথা ভাবে না। এগুলো রাষ্ট্রকে করতে হয়। কারণ, রাষ্ট্র সমাজের সমষ্টিগত মঙ্গল দেখে। রাষ্ট্র মানুষের রক্ষা করে। রাষ্ট্র দীর্ঘ মেয়াদে ভাবতে পারে, যা ব্যবসায়ী ব্যক্তি বা বাজার সব সময় পারে না। 

একটি ছোট্ট মোবাইল অ্যাপ এখন কয়েক কোটি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। একটি কোম্পানি পৃথিবীর অর্ধেক বাজার দখল করতে পারে। একটি দেশ আরেক দেশের ওপর অর্থনৈতিক আধিপত্য তৈরি করতে পারে। দাম বাড়ানো বা কমানোয় একমুহূর্তে হাজারো মানুষের জীবনকে নাড়িয়ে দিতে পারে। এখনকের পৃথিবীতে স্বার্থ ও বিবেকের সংঘর্ষ আরও বেশি তীব্র। একটি প্রযুক্তির লাভ কোটি কোটি ডলার। কিন্তু সেই প্রযুক্তি যদি মানুষের তথ্য চুরি করে, গোপনীয়তা নষ্ট করে, মানুষের মনকে প্রভাবিত করে, তাহলে অদৃশ্য হাত অন্ধকার ছায়ায় রূপ নেয়। 

অন্যদিকে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে বাজার মানুষের জীবন উন্নত করেছে। নতুন চাকরি, নতুন বিজ্ঞান, নতুন শিল্প। স্বার্থ এখানে সৃজনশীলতা সৃষ্টি করেছে। স্মিথের ধারণা এখানেই প্রাসঙ্গিক। মানুষকে বুঝতে হবে, কোন স্বার্থ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়, আর কোন স্বার্থ সমাজকে ভেঙে দেয়। অদৃশ্য হাতের উত্তরাধিকার অ্যাডাম স্মিথের তত্ত্ব আজও জীবন্ত। 

অ্যাডাম স্মিথ আমাদের শিখিয়েছেন, সমাজ এক অদৃশ্য বয়নচক্র, অগণিত মানুষের কাজ, চিন্তা, ইচ্ছা, সীমাবদ্ধতা সব মিলে গঠিত হয় সেই বিশাল বস্ত্র। আমরা মনে করি, আমরা একা একা কাজ করি, একাই ভোগ করি, একাই উৎপাদন করি। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি সিদ্ধান্তের সঙ্গে লাগানো থাকে হাজারো মানুষের অদৃশ্য অবদান। 

অদৃশ্য হাত হয়তো সেই অদৃশ্য শিকল, যা আমাদের নিজেদের অজান্তেই সমাজের সুশৃঙ্খলতার সঙ্গে বেঁধে রাখে। স্মিথের তত্ত্ব আজও পাথেয়; কারণ, তিনি অর্থনীতি নয়, মানুষকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এই ব্যাখ্যাই তার উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকারই আজও রাষ্ট্রকে সতর্ক করে, বাজারকে চ্যালেঞ্জ জানায়, মানুষকে নৈতিকতার কথা মনে করিয়ে দেয়। মানুষ স্বার্থের প্রাণী–কিন্তু সে অন্ধ স্বার্থের প্রাণী নয়।