কানাকুয়ো আর পাখির কুসংস্কার
কানাকুয়ো আর পাখির কুসংস্কার
এদের কেউ বলে আইড়া মুরগি, আবার কারও কাছে পরিচিত আইড়া কুত্তি নামে। কেউ ডাকে ডাকাত পাখি, কেউ বলে যমকুলি, আবার কারও কাছে পরিচিত হিংস্র পাখি হিসেবে। আমি তাদের জানতাম আলো-আঁধারির সন্তান হিসেবে।
দুই দশকের অধিক সময় ধরে বন্য প্রাণী সংরক্ষণে নিয়োজিত রয়েছি। তবে এর আগের গল্প হচ্ছে নিধনের ইতিহাস। তখন রাতদিন ছুটে বেড়াতাম বন্য জন্তু আর পাখির পেছনে। তবে একটা বিষয় আজও অনস্বীকার্য, বন্য প্রাণীর জগৎ সম্পর্কে আমার যেটুকু ধারণা বা জ্ঞান, এর বেশির ভাগই অর্জিত হয়েছিল সেই ফেলে আসা শিকারি জীবনে। একসময় শিকারের নেশায় একেক দিন একেক প্রাণীর পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজের অজান্তে তার সম্পর্কিত নানা তথ্য জানা হয়ে গিয়েছিল। এসব এখন অর্থাৎ এই লেখক জীবনে বেশ কাজে দেয়। সহায়ক কোনো গ্রন্থের বদলে অতীতে ডুবে গেলেই অনেক কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়।
আসলে শিকারি জীবনের নানা ধরনের বিচিত্র কাহিনি রয়েছে। তখনকার একটা বিষয় তুলে ধরি। তখন নানা জায়গা থেকে লোকজন আমার কাছে আসত বিশেষ আবদার নিয়ে। আসলে সেই আবদারের পেছনে লুকিয়ে থাকত রোগ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তখন বন্য প্রাণী সম্পর্কে নানা ধরনের কুসংস্কার ছড়িয়েছিল সমাজে। বিশেষ করে কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো পাখি কিংবা বন্য জন্তুর দেহের হাড়-মাংস, চামড়া, তেল, পালক ইত্যাদি।
সেই সময় অনেকেই বিশ্বাস করত, শঙ্খচিলের মাংস খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়, অনেকেই শত্রুকে বিপর্যস্ত করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত চিলের মাংস। উদ্বিড়ালের চামড়া ব্যবহৃত হতো বাচ্চাদের বমি বন্ধ করার তাবিজ তৈরিতে, বাত রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো শেয়ালের মাংস আর তেল। যৌন উত্তেজক ওষুধ হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত ছিল শুশুকের তেল, একই উপকারের আশায় অনেকে চিবিয়ে খেত পুরুষ চড়ুইয়ের মাথা। শ্বাসকষ্টের ওষুধ তৈরি করা হতো কলা বাদুড় দিয়ে, কারও শরীরে পানি এলে হাত-পায়ে বেঁধে দেওয়া হতো পানকৌড়ির হাড়। সাপের শরীরে একধরনের পরজীবী জন্মায়, যা দেখতে অনেকটা ছোট শামুকের মতো, এই পরজীবীকে ভাবা হতো নিঃসন্তান দম্পতিদের ব্যবহারের অক্ষয় তাবিজ।
এসব উদ্ভট চিকিৎসাপদ্ধতি আর ভ্রান্ত ধারণা সমাজে প্রচলিত ছিল যুগের পর যুগ ধরে। যেহেতু শিকারের উছিলায় বন্য প্রাণীর জগতে প্রত্যক্ষ বিচরণ ছিল আমার, তাই এই বিষয়গুলো সম্পর্কে একদম বাস্তবিক জ্ঞান আহরণের সুযোগ হয়েছিল।
গ্রামাঞ্চলে তখন প্রসূতি মায়েরা এক বিশেষ অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়ত। গ্রাম্য ভাষায় সেই অসুখের নাম ছিল ‘সুতিকা’। এটা আসলে একধরনের পেটের পীড়াজনিত সমস্যা। প্রসূতি মা ক্রমাগত পাতলা পায়খানা করতে থাকত। পরবর্তী সময়ে বুকের দুধ গ্রহণের ফলে একই অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়ত শিশুটিও। এই অসুখের একমাত্র ওষুধ ছিল কানাকুয়ো বা কুবো পাখির মাংস, যা মাকে রান্না করে খাওয়ানো হতো।
গ্রামের লোকজনের অনুরোধে মাঝেমধ্যেই আমাকে কানাকুয়ো শিকার করতে হতো। কানাকুয়ো বা কুবোর নামের কোনো অন্ত ছিল না। তবে এই পাখির সবচেয়ে প্রচলিত নাম কানাকুয়া।
এদের কেউ বলে আইড়া মুরগি, আবার কারও কাছে পরিচিত আইড়া কুত্তি নামে। কেউ ডাকে ডাকাত পাখি, কেউ বলে যমকুলি, আবার কারও কাছে পরিচিত হিংস্র পাখি হিসেবে। আমি তাদের জানতাম আলো-আঁধারির সন্তান হিসেবে।
কারণ তীব্র আলো ওরা কখনোই পছন্দ করত না, শিকার শেষে দেখতাম দ্রুত ফিরে যেত বাঁশঝাড় কিংবা ঝোপের নিচের আধো অন্ধকারে। ওটাই ওদের স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ ক্ষেত্র।

শিকারসমেত কুবো। ছবি: সংগৃহীত
একবার গ্রামের বদরুদ্দিন মিয়া দৌড়ে এসে আমাকে বলে, ‘আপনাদের বাগানবাড়ির বাঁশঝাড়ের ভিতর একটা আইড়া মুরগি আর ইন্দুরা গোমা সাপ খেলা করতেছে।’ খবরটা শুনে দ্রুত বন্দুক নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে গেলাম। বদরুদ্দিনকে দাঁড় করিয়ে রেখে চুপিসারে ঢুকে পড়লাম বাঁশঝাড়ের অভ্যন্তরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক অভাবনীয় দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের সামনে।
প্রায় চার ফুট লম্বা একটা খৈইয়া গোখরা ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার চারপাশে পাখা ছড়িয়ে নাচের ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা পাখি। দৃশ্যটা আসলে দেখতে একটা খেলার মতোই লাগছে, তবে জীবন-মৃত্যুর খেলা। সাপটা ফনা নামিয়ে যেই পালানোর চেষ্টা করে, অমনি পাখিটা ছুটে এসে দুই পায়ের নখ দিয়ে তাকে জাপটে ধরে ঠোকড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ ঠোকর দিয়ে সরে যায় দূরে, তবে অল্প সময় পর আবার ফিরে আসে।
তখন দুপুর। বাঁশঝাড়ের নিচে সেই বিশেষ দৃশ্যের সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম বন্দুক হাতে। তবে কাউকেই গুলি করার ইচ্ছে জাগল না মনে। চার ফুট লম্বা গোখরা কম শক্তিশালী নয়, পাখিটাকে একবার নিজের প্যাঁচের মধ্যে ফেলতে পারলে অবস্থা কাহিল বানিয়ে ফেলবে। তবে পাখিটাও যেন সেই কথা ভালো করেই জানে। অনেকটা ‘হিট অ্যান্ড রানে’র আদলে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সে। আর আমি অপেক্ষা করছিলাম আসলে লড়াইটা কীভাবে শেষ হয় দেখার জন্য।
পাখিটার যেন জানাই ছিল ঠান্ডা রক্তের সরীসৃপ খুব বেশি সময় উত্তেজনাকর লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে না। ক্রমাগত আক্রমণের মুখে কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছিল না সাপ। এরপর একসময় আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে। আর তখনই পাখিটা এসে দুই পায়ের নখ দিয়ে তার ঘাড় চেপে ধরে, একের পর এক ঠোকড়ে ছিঁড়ে ফেলে শিরা-উপশিরা। তারপর সাপের দেহটা যখন পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে আসে, তখনই পাখিটা শুরু করে তার ভক্ষণপ্রক্রিয়া।
দুর্দান্ত এই সাপ শিকারি পাখিটি কিন্তু ইগল, বাজ, চিল কিংবা পেঁচা পরিবারের কেউ নয়। সে হচ্ছে কোকিল পরিবারের সদস্য, অথচ কি দুর্দান্ত শিকারি। কোকিল পরিবারের সদস্য হলেও এরা নিজে বাসা তৈরি করে এবং তাতে ডিম দেয়। এরাই হচ্ছে কুবো।
দেশে এদের দুটো প্রজাতি রয়েছে: একটি হচ্ছে বড় কুবো বা গ্রেটার কুকাল, অন্যটি ছোট কুবো, কুক্কা বা লেসার কুকাল। তবে এরা দেখতে প্রায় একই রকম, ডানার রং তামাটে বাদামি, মাথা আর লম্বা লেজটি দেখতে কালো। আর রয়েছে টকটকে লাল দুটো রক্তচক্ষু। এদের দেশের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়। ওড়ার চাইতে এরা মাটিতে বিচরণ করতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
জলাভূমির পার্শ্ববর্তী ঝোপজঙ্গল এবং বাঁশঝাড় এদের প্রিয় আবাসস্থল। আমি যে পাখিটিকে গোখরোর সঙ্গে লড়াই করতে দেখেছিলাম, সেটা আসলে ছিল একটা বড় কুবো, আকৃতিতে অনেকটা দাঁড়কাকের মতো। সাপ ছাড়াও এদের প্রিয় খাদ্যের মধ্যে রয়েছে শামুক। তাই ওরা যেখানে বসবাস করে, তার আশপাশে প্রচুর শামুকের খোলস পড়ে থাকতে দেখা যায়। এরা ব্যাঙ, ইঁদুর কিংবা গিরগিটি শিকারেও সিদ্ধহস্ত। এদের অনেকে ডাকাত পাখি বলে থাকে বিশেষ কারণে।
প্রায় সময় এরা পাখির বাসা থেকে ডিম-বাচ্চা চুরি করে খায়। এমনকি কখনো কখনো অন্য পাখির বাসা থেকে বাচ্চা ছিনতাই করে এনে নিজের বাচ্চাদের খাওয়ায়। আর সাপের সাথে এদের পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকে। বাচ্চারা একটু বড় হয়ে উঠলেই কুবো একের পর এক ছোট ছোট সাপ নিয়ে আসে বাসায়। আর বাচ্চারা গপাগপ ওদের গিলে খায়। বিষধর চন্দ্রবোড়া থেকে নির্বিষ ঢোঁড়া; কুবোর হাত থেকে কারও নিস্তার নেই।

কুবোর মুখে দুধরাজ সাপ। ছবি: সংগৃহীত
কুবোর বাচ্চারা দেখতে ভয়ানক কুৎসিত রকমের হয়। আর ডাকে একধরনের রিন রিন শব্দে। নির্জন জঙ্গলে সেই রিন রিন ডাক অত্যন্ত ভয়জাগানিয়া। আমি বহুবার এই ভৌতিক শব্দের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে কানাকুয়োর ছানাদের দেখা পেয়েছি।
কানাকুয়ো ডাকে ‘কুব-কুব’ শব্দে। গ্রামীণ সমাজে এই ডাক নিয়ে নানা ধরনের কুসংস্কার ছড়িয়ে আছে। এদের ডাককে অশুভ কিংবা মৃত্যুর লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়। আর মানুষ সবচেয়ে আতঙ্কিত হয় রাতের বেলায় কুবো ডেকে উঠলে, লোকজনের ধারণা এ হচ্ছে ঘোর অমঙ্গলের লক্ষণ। এসব আসলে খুবই ভ্রান্ত ধারণা। শুধু কুবো নয়, অন্যান্য পাখি দিনে কিংবা রাতে ডাকাডাকি করে নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য।